স্কুলের গণ্ডি না পেরনো লোকও রাজনীতির বদান্যতায় কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি হয়ে বসায় আক্ষেপ করেছিলেন তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায়। তাঁর মত ছিল, যাঁরা কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি হবেন, তাঁদের একটা ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা উচিত। এ বার আরও এক ধাপ এগিয়ে দলের আর এক প্রবীণ নেতা তথা রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সরাসরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হওয়ারই বিপক্ষে রায় দিলেন।
শুক্রবার জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনের শতবর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানের সূচনায় সুব্রতবাবু বলেন, “আমরা চাই না, রাজনৈতিক লোকেরা সরাসরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকুন। আমরা চাই, বাইরে থেকে আপনাদের সাহায্য করতে।” নিজের বিধায়ক তহবিল থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা ওই স্কুলকে দেওয়ার কথা ঘোষণা করে তিনি বলেন, “আশা করি, এই স্কুলে সমস্যা হবে না। কিন্তু যদি কোনও সমস্যা হয়, সব সময়েই পাশে আছি।” সরাসরি যুক্ত না হয়েও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কী ভাবে সাহায্য করা যায়, এ দিনের এই আর্থিক সহায়তার মাধ্যমেই সুব্রতবাবু তা বুঝিয়ে দিলেন বলে অনেকেই মনে করছেন।
কিন্তু তাঁরা সত্যিই যদি না চান, তবে আরাবুল ইসলামের মতো ব্যক্তিরা কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি হন কী ভাবে? এ দিন সন্ধ্যায় এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব এড়িয়ে গিয়ে সুব্রতবাবু বলেন, “নির্দিষ্ট করে কারও নাম করব না। আমি যা মনে করি, সেটাই আমার বক্তৃতায় বলেছি। এ নিয়ে আর কিছু বলব না।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শাসক দলের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘকাল ধরেই এ রাজ্যের ঐতিহ্য। শিক্ষানুরাগীদের অনেকের অভিযোগ, বাম আমলে আলিমুদ্দিনের অনুমোদন ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজই হত না। শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ সব বিষয়েই আলিমুদ্দিনের সবুজ সঙ্কেত দরকার হত। এমনকী, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগেও অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষাগত যোগ্যতার থেকে শাসক দলের আনুগত্যই বিচার্য হত বলে আক্ষেপ বহু শিক্ষাপ্রেমীর।
রাজ্যে পালাবদলের পরে শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে রাজনীতিকে নির্বাসন দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল তৃণমূল সরকার। কিন্তু অভিযোগ, সেই প্রতিশ্রুতি জলাঞ্জলি দিয়ে রাজ্যের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালনায় দলেরই নেতা-মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদদের এনে বসানো হয়েছে। সেই সুবাদেই দাপুটে নেতা আরাবুল ইসলাম ভাঙড় কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি হয়েছেন। শিক্ষিকাকে জলের জগ ছুড়ে মারার মতো ঘটনায় তাঁর নাম জড়িয়েছে।
এর আগে সৌগতবাবুও নিজের মতটি প্রকাশ করেছিলেন। আরাবুলের নাম নেননি। সুব্রতবাবুও এ দিন তাঁর মত বিশদে ব্যাখ্যা করেননি। তৃণমূলের যে সব নেতা-নেত্রী এক বা একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তা হয়ে রয়েছেন, দল তাঁদের ফিরিয়ে নেবে কি না, সেই প্রশ্নের তাই উত্তর মেলেনি। তা হলে কি নানা মহলে সমালোচনা হওয়ায় তৃণমূল তথা রাজ্য সরকার এই ব্যাপারে তাদের মত পরিবর্তন করছে এই প্রশ্নও এ দিন শোনা গিয়েছে অনেকের মুখে।
রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু অবশ্য সুব্রতবাবুর মত নিয়ে সরাসরি কোনও মন্তব্য করেননি। যেমন অতীতে সৌগতবাবুর মত সম্পর্কেও তিনি প্রথমে সরাসরি কিছু বলেননি। পরে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন, প্রথাগত শিক্ষাগত যোগ্যতাকেই সব সময় মাপকাঠি ধরা চলে না। সুব্রতবাবুর বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি এ দিন বলেন, “সৌগতবাবু, সুব্রতবাবু দু’জনেই বর্ষীয়ান নেতা। তাঁদের মত জানিয়েছেন। আমরাও এই নিয়ে চিন্তা করছি। তবে এখনই এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করছি না।”
তবে শিক্ষা জগতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের অনেকেই এ দিন সুব্রতবাবুর মতকে স্বাগত জানিয়েছেন। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক অভিরূপ সরকার বলেন, “সুব্রতবাবু খুবই ভাল কথা বলছেন। বিশেষত সিপিএমের আমলে রাজনীতি এ রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে।” রাজ্য সরকারের উচ্চশিক্ষা দফতরের নানা কাজে অভিরূপবাবু যুক্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিতরে থেকেও অনেকেই বিভিন্ন দলের অনুগত হয়ে রাজনীতি করে গোটা ব্যবস্থাটার ক্ষতি করেন বলেও তিনি আক্ষেপ করেন।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (কলকাতা)-র অধ্যাপক অনুপ সিংহ মনে করেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্বে কাদের থাকা উচিত, তা নিয়ে সেই অর্থে খুব একটা বিতর্কের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, “যাঁরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় থাকবেন, তাঁদের একটা শিক্ষাগত যোগ্যতা তো থাকা জরুরি। আর সেটা হবে প্রতিষ্ঠানের ধরন-ধারণ, সুনাম-চরিত্র ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে।” সুব্রতবাবুর এ দিনের মত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যাঁরা সক্রিয় রাজনীতি করবেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁদের সরাসরি না জড়ানোই ভাল।” |