রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাত-পর্বে যোগ হল নতুন মাত্রা!
রাজ্যপালকে তাঁরা নজরে রাখছেন বলে বৃহস্পতিবার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
মন্ত্রীর সেই বক্তব্য নিয়ে প্রশ্নের জবাবে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন শুক্রবার জবাব দিয়েছেন, “আমি যে এখনও নিরাপদে আছি, তাতেই খুশি!” ভাঙড়ের ঘটনা নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজ্যপালের এই মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে প্রশাসনিক মহল মনে করছে।
ঘটনাচক্রে, সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জবাব দেওয়ার যে দায়িত্ব ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে সুব্রতবাবুকেও দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তার থেকে আপাতত পঞ্চায়েতমন্ত্রীকে অব্যাহতি দেওয়া হল বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। সেই জায়গায় আপাতত এলেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। প্রশ্ন উঠেছে, এই দায়িত্ব বদলের সঙ্গে কি রাজ্যপাল-বিতর্কের যোগ আছে? তৃণমূলের একটি অংশের দাবি, সুব্রতবাবু যে ভাবে রাজ্যপাল সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, তাতে মুখ্যমন্ত্রী কিছুটা বিব্রত। তাই এর সঙ্গে রাজ্যপাল-পর্বের যোগ থাকাই স্বাভাবিক। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “রাজ্যপালের প্রকাশ্য মন্তব্যে রাজ্য সরকার খুবই বিস্মিত। তবে সুব্রতবাবু প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে একটু বেশিই এগিয়ে গিয়েছেন!” অন্য একটি অংশ অবশ্য বলছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি সংক্রান্ত কিছু মন্তব্যের জন্য দলনেত্রীর উষ্মার কারণ হয়েছেন সুব্রতবাবু। |
প্রাক্তনের সঙ্গে বর্তমান। একটি বইয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গোপালকৃষ্ণ গাঁধী
এবং এম কে নারায়ণন। শুক্রবার কলকাতায়। —নিজস্ব চিত্র |
পার্থবাবু এ দিনই রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে যান, ‘বেঙ্গল লিডস’ নিয়ে কর্তব্য পালন করতে। রাজভবন সূত্রের খবর, ভাঙড়-কাণ্ডে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে তাঁর কড়া অবস্থান রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে জানিয়ে দিয়েছেন এবং সেই মনোভাব বুঝিয়ে দিয়েছেন রাজ্য সরকারকেও।
রাজ্যপাল পদের এক্তিয়ার এড়িয়ে রাজনৈতিক মন্তব্য করেছেন মহাকরণে বসে এমন অভিযোগই করেছিলেন সুব্রতবাবু। কিন্তু রাজ্যপাল মনে করছেন, তিনি সংবিধান-নির্ধারিত ভূমিকার বাইরে যাননি। তাঁর যে ভোটে দাঁড়িয়ে জিতে আসার কোনও লক্ষ্য নেই, সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন রাজ্যপাল (“আই ডোন্ট অ্যাসপায়ার টু বি ওয়ান অফ দ্য ইলেকটেড মেম্বারস”)। রাজনৈতিক হানাহানির পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের কী করা উচিত, তা রাজ্য সরকারের জানা আছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। এ পর্যন্ত তিনি যা বলেছেন, সেই সম্পর্কে নারায়ণনের মন্তব্য, “রাজ্যপাল হিসেবে যা বলা উচিত, তা-ই বলেছি।” অর্থাৎ, সুব্রতবাবুর হলুদ কার্ডে রাজ্যপাল নরম হননি বলেই প্রশাসনিক মহলের অভিমত।
প্রাক্তন বিদেশসচিব কৃষ্ণন শ্রীনিবাসনের দু’টি বই নিয়ে এক আলোচনাচক্রে এ দিন উপস্থিত ছিলেন বর্তমান ও প্রাক্তন রাজ্যপাল নারায়ণন ও গোপালকৃষ্ণ গাঁধী। ঘটনাচক্রে, রাজ্যপাল থাকাকালীন সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলে একাধিক বার তৎকালীন শাসক দল সিপিএম নেতাদের রোষে পড়েছিলেন গোপাল গাঁধী। এ দিন এই অনুষ্ঠানের ফাঁকেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্তব্য করেন নারায়ণন।
রাজ্যপাল যখন তাঁর অবস্থানে দৃঢ়, তখনই রাজভবন-মহাকরণ সংঘাত-পর্বে ভিন্ন সুর ধরা পড়েছে শাসক দলের মধ্যে! সৌজন্যে তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায়।
সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মত উদ্ধৃত করে তিনি শুক্রবার বলেছেন, রাজ্যপাল কী বলবেন, তা রাজ্যপাল নিজেই ঠিক করবেন। অর্থাৎ, তাঁর দলীয় সতীর্থ সুব্রতবাবুর সঙ্গে সরাসরি একমত ঞহননি সৌগতবাবু। সুব্রতবাবু অবশ্য তাঁর আগের দিনের মন্তব্য থেকে পিছু হটতে নারাজ। রাজ্যপাল রাজনৈতিক মন্তব্য করেছেন বলেই তিনি এখনও মনে করছেন!
সৌগতবাবু এ দিন প্রাথমিক ভাবে বলেছিলেন, “সুব্রত মুখোপাধ্যায় অনেক দিনের অভিজ্ঞ রাজনীতিক। তিনি যা বলেছেন, ভেবেচিন্তেই বলেছেন। রাজ্যপালও যা ঠিক মনে করেছেন, বলেছেন।” কিন্তু তাঁর কী মত? এ বার সৌগতবাবু বলেন, “সুভাষ কাশ্যপ সংবিধান বিশেষজ্ঞ। উনি বলেছেন, সংবিধানে কোথাও বলা নেই যে, রাজ্যপাল কী বলতে পারবেন বা কী বলতে পারবেন না। আমার মত সুভাষ কাশ্যপের মত।” বর্ষীয়ান সাংসদের আরও বক্তব্য, “তা ছাড়া, রাজ্যপাল কী বলবেন, তা রাজ্যপাল নিজে ঠিক করবেন! অন্য দু’জনের বিতর্কের মধ্যে আমি নাক গলাব কেন?”
নাম না-করে সৌগতবাবুকে কটাক্ষ ফিরিয়ে দিয়েছেন সুব্রতবাবুও। গড়িয়াহাটে একটি স্কুলের অনুষ্ঠানে এ দিন তাঁকে সৌগতবাবুর মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি সংবিধান বিশেষজ্ঞ নই। যাঁরা বিশেষজ্ঞ, তাঁদের জিজ্ঞেস করুন! আমি যা বলার বলে দিয়েছি।” সৌগতবাবু তো বলেছেন, রাজ্যপাল কী বলবেন, সেটা রাজ্যপালই ঠিক করবেন? সুব্রতবাবুর উত্তর, “পৃথিবীর লোক বলুক!” রাজ্যপাল নিয়ে তাঁর মন্তব্যে তিনি কি অটল? সুব্রতবাবুর জবাব, “অবশ্যই! আমি ১০০% নিশ্চিত, রাজ্যপাল রাজনৈতিক মন্তব্য করেছেন!”
গোপাল গাঁধী যখন রাজ্যপাল ছিলেন, তখন তাঁর সম্পর্কে বিনয় কোঙার বা শ্যামল চক্রবর্তীর মতো সিপিএম নেতাদের মন্তব্য উল্লেখ করে রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ বলছে, ক্ষমতায় থাকাকালীন বামেরাও সুব্রতবাবুর পথেই হেঁটেছিলেন। কিন্তু প্রাক্তন মন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাঁদের আমলে মহাকরণে বসে মন্ত্রীরা কেউ রাজ্যপাল-বিরোধী বিবৃতি দেননি। যা বলার, রাজনৈতিক ভাবে তাঁদের দলের নেতারা বলতেন।
রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে এ দিন আইসিডিএস কর্মী সমিতির এক সমাবেশে সূর্যবাবু বলেন, “আমরা যখন সরকারে ছিলাম, মন্ত্রীরা এ সব করেননি। মন্ত্রীদের রাজ্যপাল নিয়োগ করেন। তাঁদের কিছু বলার থাকলে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে পারেন। রাজ্যপালকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কিছু বলতে পারে। তাদের মুখ বন্ধ করা যায় না। কিন্তু মন্ত্রীরা বলা মানে সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়।” তবে একই সঙ্গে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যবাবুর বক্তব্য, “রাজ্যপাল প্রকাশ্যে বলতে পারেন কি পারেন না, তার মধ্যে যাচ্ছি না। কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্ক, তার মধ্যে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের ভূমিকা, এ সব নিয়ে আমাদের দলের অনেক মতামত আছে।” সূর্যবাবু এ কথা বললেও কংগ্রেস-তৃণমূলের অভিযোগ, বাম জমানায় মন্ত্রী হিসেবেই প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তবে সিপিএম নেতৃত্বের পাল্টা বক্তব্য, সুভাষবাবুর অনেক আচরণের কোনও হিসেব আলিমুদ্দিনের হাতে ছিল না! আইসিডিএস কর্মী নিয়োগের কমিটিতে দলতন্ত্রের প্রতিবাদ জানিয়ে এ দিনই রাজ্যপালকে চিঠি দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা।
নারায়ণনের ‘গুন্ডারাজ’ মন্তব্যের পাশে দাঁড়িয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য এ দিন বলেছেন, “সুব্রতবাবু জানেন না, রাজ্যপালকে কেউ হলুদ কার্ড দেখালে তাঁর উপরে একটা সরকার আছে। তারা লাল কার্ড দেখাতে পারে!” আইনশৃঙ্খলার গুরুতর অবনতি মানুষ বুঝতে পারছেন বলেই প্রদীপবাবুর মত। একই সুরে আইসিডিএস সমাবেশে সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামলবাবুর মন্তব্য, “রাজ্যপালকে ওঁরা (সরকার) নজর রাখবেন কি? মানুষ ওঁদের জন্য লাল কার্ড পকেটে নিয়ে বসে আছেন!” |