এই রাজ্যে ঢুকলেই প্রাণ হাতে চলা: কোর্ট
গুজরাত দূর অস্ত্, বিহার যা পারে, তা-ও পারছে না পশ্চিমবঙ্গ!
এ রাজ্যে রাস্তাঘাটের করুণ হাল নিয়ে আমজনতার অভিযোগ বহু দিনের। জাতীয় সড়কের বেহাল দশা নিয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি। সেই মামলার শুনানিতে এ দিন বর্তমান প্রধান বিচারপতি রাজ্যের প্রতিনিধিকে বললেন, “মাননীয় জিপি, আমাকে বলতেই হবে যে, বিহারের রাস্তাঘাটও এ রাজ্যের থেকে ভাল।”
মাস কয়েক আগেই উত্তরবঙ্গ সফর সেরে মহাকরণে ফিরে জাতীয় সড়কের হাল নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক’দিন আগেও বীরভূম যাওয়ার পথে পানাগড় থেকে ইলামবাজার পর্যন্ত বেহাল রাস্তা দেখে ক্ষুব্ধ হন তিনি। গাড়ি থেকেই মমতা ফোন করেন পূর্তমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদারকে। এর পরেই তড়িঘড়ি ওই রাস্তা সারাইয়ের কাজ শুরু করে দেয় পূর্ত দফতর। তাৎপর্যপূর্ণ হল, রাজ্যের শিল্প পরিকাঠামোর কথা বলতে গিয়ে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও মাঝেমধ্যেই রাস্তাঘাটের বেহাল দশার কথা টেনে আনেন।
মাস কয়েক আগে উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে ৩১সি নম্বর জাতীয় সড়কের হাল দেখে আসার পর হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জে এন পটেল জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন। কারও অভিযোগের ভিত্তিতে নয়, তিনি ওই মামলা করেছিলেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। সেই মামলার শুনানিতে জলপাইগুড়ির জেলাশাসককে ডেকে পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল, রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার এমন হাল দেখেও প্রশাসন কী ভাবে ঘুমিয়ে আছে? জবাবে কয়েক দিনের মধ্যেই মেরামতের কাজ শুরুর প্রতিশ্রুতি দিয়ে সময় চেয়েছিল রাজ্য। তার পরে কেটে গিয়েছে এত দিন। পাথর ফেলে ধীর গতিতে সবেমাত্র তাপ্পি দেওয়া চলছে ওই রাস্তায়। ইতিমধ্যে কলকাতা হাইকোর্ট থেকে অবসর নিয়ে মহারাষ্ট্রে ফিরে গিয়েছেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি পটেল। কিন্তু তাঁর দায়ের করা মামলার শুনানিতেই বৃহস্পতিবার ফের বিড়ম্বনায় পড়তে হল রাজ্য সরকারকে।

সবেমাত্র পাথর ফেলে তাপ্পির কাজ চলছে মাদারিহাট-হাসিমারা ৩১সি জাতীয় সড়কে। —নিজস্ব চিত্র
এ দিন ওই মামলারই শুনানি ছিল হাইকোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচির ডিভিশন বেঞ্চে। শুনানি চলাকালীন প্রধান বিচারপতি মিশ্র মন্তব্য করেন, শুধু বিহার নয়, হিমাচলপ্রদেশের রাস্তাও দেখার মতো। কিন্তু বিহার পার হয়ে এ রাজ্যে ঢোকা মাত্রই মনে হয় প্রাণ হাতে নিয়ে চলতে হচ্ছে। এই অভিজ্ঞতা তাঁর নিজের। এ রাজ্যের জাতীয় সড়কে পড়েই রাস্তার দশা হাড়ে হাড়ে টের পান তিনি।
এ দিন শুনানির শুরুতেই প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির সুরেই বর্তমান প্রধান বিচারপতি জাতীয় সড়কের হাল এত খারাপ কেন, তা রাজ্য সরকারের কৌঁসুলি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চান। অশোকবাবু বলেন, “আমাদের এখানে মাটি অন্য রকম।” তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমি তা পুরোপুরি অস্বীকার করছি না। কিন্তু স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করলে রাস্তা ভাল ভাবে তৈরি করা যায়।” রাজ্য সরকারের তরফে বলা হয়, ওই সব রাস্তা তৈরির দায়িত্ব জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের (এনএইচএআই)। তাঁদের তরফে সহযোগিতার অভাব রয়েছে।
সত্যিই কি তা-ই?
কোনও কোনও জাতীয় সড়কের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষেরই হাতে থাকে, কিছু ক্ষেত্রে থাকে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পূর্ত দফতরের হাতে। ৩১সি জাতীয় সড়কের যে অংশটি নিয়ে এই মামলা, তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পূর্ত দফতরেরই। এর টাকা আসে কেন্দ্রীয় সড়ক মন্ত্রকের কাছ থেকে। অভিযোগ, সেই টাকা পেয়েও রাজ্য তাদের দায়িত্বটুকু পালন করছে না।
এ দিন জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের আইনজীবী অনিরুদ্ধ রায় জানান, রাস্তা তৈরি করতে তাঁরা প্রস্তুত। কিন্তু সে কাজ করতে হলে জাতীয় সড়কের কিছু কিছু অংশ সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখতে হবে। সেই সময়টায় বিকল্প রাস্তা তৈরি করে যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য আর্থিক বরাদ্দও মজুত থাকলেও প্রয়োজনীয় জমি পাওয়া যাচ্ছে না।
জাতীয় সড়ক-কর্তৃপক্ষের ইঞ্জিনিয়াররা জানাচ্ছেন, কোনও রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এক, রাস্তা যত চওড়া হয়, তার উপর যানবাহনের চাপ তত কম পড়ে। কাজেই, দুই লেনের পরিবর্তে রাস্তা চার লেনের হলে রাস্তা বেশিদিন টিঁকে থাকে। দুই, রাস্তা চওড়া হলে সময়ে সময়ে দু’একটা লেন বন্ধ রেখে খারাপ অংশ প্রয়োজনমতো মেরামত করা যায়। তিন, রাস্তার পাশে জায়গা থাকলে সেখানে বিকল্প রাস্তা করে সেই পথে যানবাহন ঘুরিয়ে খারাপ রাস্তা সারানো যায়। তিনটি ক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত জমি সড়ক কর্তৃপক্ষের হাতে থাকতে হয়। এই জমি জোগানোর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের। কিন্তু এ রাজ্যে সেটাই সম্ভব হচ্ছে না বলে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের ইঞ্জিনিয়ারদের মত।
দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে রাজ্য সরকারের জিপি-র কাছে ডিভিশন বেঞ্চ জানতে চায়, কত দিনে কাজ শেষ হবে। অশোকবাবু জানান, বর্ষার পরে। প্রধান বিচারপতি বলেন, সে তো অনেক দেরি। এখনই কেন নয়? এ দিন ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, কবে কাজ শুরু হবে, কত দিনে শেষ হবে, জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ কবে কাজ শুরু করবেন, তা বিস্তারিত ভাবে ২০ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টকে জানাতে হবে। হাইকোর্ট এ রকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দায়সারা মনোভাব বরদাস্ত করবে না।
এ দিন যে রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা প্রধান বিচারপতি টেনেছেন, সেই বিহার কী ভাবে জাতীয় সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ করে? বিহারের সড়ক উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী নন্দকিশোর যাদবের দাবি, “বিহারে রাজ্য জুড়ে ঝকঝকে রাস্তা হওয়ার মূলত দু’টি কারণ। জবরদস্ত পরিকল্পনা এবং লাগাতার নজরদারি। আমরা যে কোনও কাজ সময়ে শেষ করায় জোর দিই। সময়ে শেষ করতে না পারলে ঠিকাদারদের দেয় অর্থ কেটে নেওয়া হয়। আবার সময়ের আগে শেষ করলে পুরস্কৃতও করা হয়।”
বিহারে যে জমি অধিগ্রহণে সমস্যা নেই, তা-ও জানিয়ে দেন নন্দকিশোর। বলেন, “আমরা অনেক আগেই রাজ্যের জন্য সুস্পষ্ট জমি-নীতি তৈরি করেছি। তাতে জমিদাতাদের সরকারি মূল্যের আড়াই গুণ টাকা দেওয়া হচ্ছে। এই নীতি কিন্তু বিহারে জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে। তাই জাতীয় সড়ক কিংবা অন্য জনহিতকর কাজে জমি পেতে আমাদের সমস্যা হয় না।”
জাতীয় সড়ক-কর্তৃপক্ষের মতো এ রাজ্যের পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়াররাও মনে করেন, জমির সমস্যা না থাকলে অনেক আগেই রাজ্যের জাতীয় সড়ক কিংবা রাজ্য সড়কগুলির চেহারা পাল্টে যেত। স্রেফ জমি না মেলায় জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজে এগোতেই পারেননি। বিভিন্ন জায়গায় সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়েও আটকে গিয়েছে। কোথাও আবার অধিগৃহীত জমি দখল হয়ে গিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সেই দখলদার সরাতে প্রশাসনও তেমন উদ্যোগী নয়। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের এক ইঞ্জিনিয়ার বলেন, “অনেক জায়গাতেই আমরা জমির দখল না পেয়ে শেষ পর্যন্ত কাজ গুটিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছি। আমাদের প্রয়োজন ২৩৯০ একর জমি। এখনও পর্যন্ত পেয়েছি ৯০ একর।”
রাজ্যের পূর্তমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার বিষয়টি বিচারাধীন বলে এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে তাঁর দফতরের কর্তারা কেন্দ্রীয় সরকারের উপরেই সব দায় চাপিয়ে দিয়েছেন। এক কর্তার মন্তব্য, “একাধিক জাতীয় সড়কের বেশ কিছু অংশ সারানোর জন্য অনেক দিন ধরেই কেন্দ্রের কাছে দরবার করছি। শেষে অল্প দিন আগে টাকা পাওয়া গিয়েছে। সেই টাকায় উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু রাস্তার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে।”
কলকাতা ফেরার সময় ৩১সি নম্বর জাতীয় সড়কের যে অংশ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি, সেই মাদারিহাট থেকে হাসিমারা পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার জাতীয় সড়কের হাল এতই খারাপ যে, তার প্রভাব পড়েছে পর্যটন শিল্পে। এক বার ওই রাস্তায় গেলে দ্বিতীয় বার কেউ আর যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চান না। ওই সড়কের জন্যই উত্তরবঙ্গে একশৃঙ্গ গন্ডারের বিচরণভূমি জলদাপাড়ায় পর্যটন ব্যবসা মার খেয়েছে। বেশ কিছু পর্যটক ওই রাস্তার কথা জানার পর বুকিং বাতিল করেছেন বলে দাবি পর্যটন আবাসের কয়েক জন কর্তার। জলদাপাড়া হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক স্বপন রায় বলেন, “সরকারের বেহাল রাস্তার জন্য পর্যটকদের কটূ কথা আমাদের শুনতে হচ্ছে। রাস্তা সারানো না হলে পর্যটন শিল্পের কী উন্নতি হবে তা বুঝতে পারছি না।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.