হিংসায় উদ্বিগ্ন রাজ্যপালের রিপোর্ট দিল্লিকে
রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও চলতি রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে রিপোর্ট পাঠালেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন।
ভাঙড়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে দু’দিন আগে রাজ্যপাল বলেছিলেন, “যা চলছে, তা হল গুন্ডারাজ।” কিন্তু প্রকাশ্যে সেই মত জানানোর আগেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে কেন্দ্রের কাছে ওই রিপোর্ট পাঠিয়েছেন তিনি। ভাঙড়-কাণ্ডের আগেই কেন্দ্রকে পাঠানো ওই রিপোর্টে রাজ্যে ‘সমাজবিরোধীদের দাপটের’ জন্য নারায়ণন যেমন পুলিশি ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দায়ী করেছেন, তেমনই সমালোচনা করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসেরও। গত মাসেই দিল্লিকে এই রিপোর্ট পাঠিয়েছেন তিনি। সেখানে তাঁর বক্তব্য, রাজ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষের পাশাপাশি ইদানীং তৃণমূল কংগ্রেসে অভ্যন্তরীণ কলহও বাড়ছে। রাজনৈতিক সংঘর্ষের অনেকটাই হচ্ছে তৃণমূলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের কারণে। তৃণমূলের কিছু বিধায়কের নেতৃত্বে বিভিন্ন গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে। এই সব হিংসার ঘটনা হচ্ছে মূলত জমি সংক্রান্ত বিবাদকে কেন্দ্র করে।
রাজ্যের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সব রাজ্যের রাজ্যপাল নিয়মমাফিক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট পাঠান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শীর্ষস্তরের এক আমলা আজ জানান, পশ্চিমবঙ্গে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নারায়ণন গোড়ায় যে সব রিপোর্ট পাঠাতেন, তাতে নেতিবাচক বিষয়বস্তু বিশেষ থাকত না। কিন্তু রাজ্যপালের সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট দেখে বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের চলতি অরাজক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন। তা ছাড়া সিপিএম, কংগ্রেস-সহ রাজ্যে বিরোধী দলগুলির প্রতিনিধিরাও তাঁর সঙ্গে দেখা করে রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা নিয়ে ধারাবাহিক অভিযোগ জানাচ্ছেন। এ সবেরই প্রতিফলন ঘটছে রিপোর্টে।
কেন্দ্রের কাছে পাঠানো ওই রিপোর্টে রাজ্যপাল রাজ্যের সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনা ও হিংসার ঘটনা সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন। সিঙ্গুরের তৃণমূল বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে সরকার বিরোধী মতপ্রকাশ, লোবা গ্রামের ঘটনা, তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের ওপর তৃণমূলেরই একাংশের হামলা ইত্যাদি সবই তুলে ধরেছেন তিনি। রিপোর্টে তিনি বলেছেন, তৃণমূলের সিঙ্গুর আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তাঁর বিদ্রোহ দেখে বোঝা যাচ্ছে, সিঙ্গুরের বহু মানুষ বর্তমান সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট। তা ছাড়া কিছুদিন আগে লোবা গ্রামে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী স্থানীয় মানুষের হাতে ক্ষতিপূরণ বাবদ চেক তুলে দিতে গেলেও সেই চেক নিতে কেউ আসেননি। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, তৃণমূল সরকার সম্পর্কে মানুষের মোহভঙ্গ হতে শুরু করেছে। পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তৃণমূল সরকার কাজ করছে না বলে মনে করছেন অনেকেই।
তৃণমূল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে রিপোর্টে রাজ্যপাল আরও বলেছেন, ক্ষমতাসীন দলের সাংগঠনিক কাঠামো অনেকটাই লাগামছাড়া। এখনই নিয়ন্ত্রণ কায়েম না করলে আরও নৈরাজ্যের পরিবেশ তৈরি হবে। তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে সরাসরি কোনও সমালোচনা করেননি রাজ্যপাল। বরং রিপোর্টে বলেছেন, চলতি পরিস্থিতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও তাঁর কথা হয়েছে। তিনি নিজেও পরিস্থিতি সম্পর্ক অবগত এবং উদ্বিগ্ন।
রাজ্যপাল হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার আগে কেন্দ্রে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন এম কে নারায়ণন। তার আগে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান ছিলেন এই প্রাক্তন আইপিএস। এখনও বর্তমান গোয়েন্দা কর্তাদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত স্তরে যোগাযোগ রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ওই শীর্ষস্তরের আমলার কথায়, “রাজ্যপালের রিপোর্ট দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গের পুলিশি ব্যবস্থা নিয়ে তিনি খুবই অসন্তুষ্ট। রিপোর্ট পড়লে এ-ও বোঝা যাবে, প্রকারান্তরে পুলিশের ঢিলেঢালা মনোভাবের জন্য তিনি শুধু বর্তমান সরকারকে দায়ী করছেন তা নয়, বরং পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের দিকেও আঙুল তুলেছেন। বস্তুত অবক্ষয় শুরু হয়েছে তখন থেকেই।”
রিপোর্টে রাজ্যপাল বলেছেন, “বহু বছর ধরে আইনশৃঙ্খলার সত্যিকারের সমস্যাগুলো হাতে-কলমে না সামলাতে সামলাতে রাজ্যের পুলিশি ব্যবস্থার মেরদণ্ডই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া নিচুস্তরের পুলিশের সদিচ্ছার অভাব ও ভীরুতার কারণেই সমাজবিরোধীরা এই ভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রিপোর্টে তিনি আরও বলেছেন, রাজ্যের জনসংখ্যার তুলনায় পুলিশের সংখ্যার অনুপাত গোটা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সবথেকে খারাপ। তার ওপর ৩০ শতাংশ পদ শূন্য পড়ে রয়েছে।
রাজ্যপালের এই রিপোর্ট প্রসঙ্গে কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা আজ বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূল নেতৃত্ব অকারণেই নারায়ণনের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন। রাজ্যে গুন্ডারাজ চলছে বলে রাজ্যপাল মন্তব্য করায় রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূলের অস্বস্তি হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু তৃণমূল নেতৃত্ব তথা মুখ্যমন্ত্রী যদি নারায়ণনের পরামর্শ নিয়ে চলেন, তা হলে সরকারেরই উপকার হবে। কারণ, এক জন প্রাক্তন পুলিশ কর্তা হিসাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শুধরোনো এবং পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে নারায়ণন মুখ্যমন্ত্রীকে ইতিবাচক পরামর্শ দিতে দিতে পারেন।
কংগ্রেসের ওই শীর্ষ নেতা জানান, আগামী সপ্তাহে রাষ্ট্রপতি কলকাতা সফরে যাচ্ছেন। রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে তখন ফের রাষ্ট্রপতির কথা হবে। আবার মুখ্যমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যেও একটি নৈশভোজের বৈঠক হবে। তা ছাড়া রাজভবনে মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে বৈঠকের সম্ভাবনাও রয়েছে। সেই বৈঠকের মধ্যে দিয়ে যেমন নারায়ণন-মমতা চলতি টানাপোড়েন কিছুটা কাটতে পারে, তেমনই মুখ্যমন্ত্রীকে ইতিবাচক পরামর্শ দিতে পারেন রাজ্যপাল ও রাষ্ট্রপতি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.