পত্রিকা: রঞ্জিত মল্লিক তা হলে এ বার শ্বশুরমশাই হচ্ছেন...
রঞ্জিত: সত্যি। একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। এত কাল ধরে মেয়ে আমার কাছে ছিল এ বার শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। মন খারাপ তো একটু হয়ই। কিন্তু মেনেও নিয়েছি। কারণ এইটাই তো পৃথিবীর নিয়ম। বহু বহু বছর ধরে এইটাই হয়ে আসছে। মেয়ে বিয়ে হলে চলে যাবে। চিরকাল তো আর বাবা-মা সন্তান পাহারা দিতে পারে না।
পত্রিকা: মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে কী পরামর্শ দিলেন?
রঞ্জিত: না। তেমন কোনও পরামর্শ দিইনি। এত বছর ধরে আমাদের বাড়িতে থেকে সকলের সঙ্গে মানিয়ে-গুছিয়ে চলার শিক্ষা ও পেয়েছে। সেই ভাবেই চলবে নিশ্চয়ই।
পত্রিকা: খুব ব্যস্ত নিশ্চয়ই? মেয়ের বিয়ে বলে কথা।
রঞ্জিত: ব্যস্ততা তো ডেফিনেটলি থাকে। বিয়ের অনেক রকম ব্যাপার থাকে তো। সব ব্যাপারটাকেই মাথায় রাখতে হচ্ছে।
পত্রিকা: নিমন্ত্রিতের সংখ্যা কত?
রঞ্জিত: লোক ভালই হবে মনে হচ্ছে। সে ভাবেই নেমন্তন্ন করছি।
পত্রিকা: বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেমন্তন্ন করছেন? কার্ডটা কেমন হয়েছে?
রঞ্জিত: সবাইকে বাড়ি গিয়ে বলতে পারছি না। অনেক নিমন্ত্রিত তো। চিঠি পাঠাব। আর ফোন করব। এখন তো এই রকমই চলছে। কার্ডের ডিজাইন হয়েছে রাধাকৃষ্ণের ছবি দিয়ে। আমার তো বেশ ভাল লেগেছে। আমার স্ত্রী দীপাই পছন্দ করেছে কার্ডের ডিজাইন।
|
পত্রিকা: অনেক দিন তো ছবি করছেন না। এমনিতে কী করে সময় কাটে আপনার।
রঞ্জিত: খুব বই পড়ি। বাংলা প্রবচন নিয়ে একটা গবেষণার কাজ করছি। বাংলা প্রবচনে কী ভাবে মানুষকে সুখে শান্তিতে রাখার কথা বলা হয়েছে সেগুলো জট ডাউন করছি। বলতে গেলে এক ধরনের আর্ট অফ লিভিং খুঁজছি।
পত্রিকা: এটা কি বই হয়ে বেরোচ্ছে?
রঞ্জিত: তা এখনই বলতে পারছি না। দেখা যাক।
পত্রিকা: অভিনয় যে করছেন না, এটা নিয়ে কিছু মনে হচ্ছে না?
রঞ্জিত: অনেক দিন তো অভিনয় করলাম। আমার এখন আর বেশি অভিনয় করতে ইচ্ছে করে না। তার চেয়ে অনেক বেশি ভাল লাগে যে কাজটার কথা বললাম সেটা করতে।
পত্রিকা: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তো এত দিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন?
রঞ্জিত: সৌমিত্রদার যে ভাবে সিনেমা, নাটক, আবৃত্তির প্রতি ভালবাসা, আমার এখন আর অতটা নেই। আমি সেই রকম ছবিতেই অভিনয় করব, যার মাধ্যমে লোকশিক্ষা হয়। আর যদি প্রচণ্ড এন্টারটেনমেন্ট থাকে, মানুষ দেখে খুব খুশি হবে সে রকম ছবিতে কাজ করতে চাই।
পত্রিকা: যখন উত্তমকুমার চলে গেলেন বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রি মুখ থুবড়ে পড়ল। তখন অঞ্জন চৌধুরীর চিত্রনাট্য, পরিচালনা, আর আপনার অভিনয়ে ‘শত্রু’র মতো পর পর ছবি বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। এও শোনা যায় ওই সময় অঞ্জন চৌধুরীকে আপনিই আবিষ্কার করেছিলেন। এই দূরদর্শিতা হল কী করে?
রঞ্জিত: অঞ্জনবাবু ‘চুমকি’ বলে একটা পত্রিকা বের করতেন। সেই পত্রিকার জন্য আমার কাছে একটা ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলেন। ‘চুমকি’-তে অঞ্জনবাবুর দুয়েকটা লেখা পড়েটড়ে আমার কী রকম মনে হল ওঁর মধ্যে সিনেমা করার সাঙ্ঘাতিক সম্ভাবনা আছে। তখন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, দীনেন গুপ্তের সঙ্গে কাজ করছি। যখনই শ্যুটিংয়ে যেতাম উনি সঙ্গে থাকতেন। আমি ওঁকে বলেছিলাম আপনি কাহিনি, চিত্রনাট্যের দিকে চলে আসুন। তখনই অঞ্জনবাবু চিত্রনাট্য শুরু করলেন। ‘শঠে শাঠ্যং’, ‘লাল গোলাপ’ ‘সঙ্কল্প’ এই সব ছবির চিত্রনাট্য শুরু করলেন।
পত্রিকা: অঞ্জন চৌধুরী যে এমন তুলকালাম হিট ছবিতে করতে পারতেন তার কারণটা কী?
রঞ্জিত: সংলাপ খুব জোরালো। আর নাটক তৈরি করার দারুণ ক্ষমতা ছিল ওঁর মধ্যে। উত্তমদা চলে যাওয়ার পরে খবরের কাগজে একটা ছবি বেরিয়েছিল স্টুডিওতে কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। অঞ্জনবাবুর কাহিনি- চিত্রনাট্য-পরিচালনা সেই দৈন্যদশা থেকে বাংলা ছবিকে তুলে নিয়ে আসে। ‘শত্রু’ ছবির ডায়লগের ক্যাসেট কী বিক্রি হয়েছে ধারণার বাইরে।
পত্রিকা: বাংলা ছবি থেকে ভাল ব্যবসা আসতে আরম্ভ করল ঠিকই। কিন্তু তখনই শহরের দর্শক আর গ্রামের দর্শক ভাগ হয়ে গেল। আপনি মানেন তো সেটা?
রঞ্জিত: সেটা হয়তো হয়েছিল। কিন্তু অঞ্জনবাবুর হাতে মুখ থুবড়ে পড়া ইন্ডাস্ট্রি তো উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার পর সেই ইন্ডাস্ট্রিকে অনেক দিন টেনে নিয়ে গেছে প্রসেনজিৎ। সেই ছবিগুলো কিন্তু খাঁটি বাঙালি গল্পের সামাজিক ছবি ছিল। তামিল তেলুগু ছবির অনুকরণ ছিল না |
পত্রিকা: শেষ দিকে অঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে আপনার মনোমালিন্য হল কেন?
রঞ্জিত: আজ যিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন, তাঁর সম্পর্কে আর ও সব নিয়ে কথা তুলব না।
পত্রিকা: আজকাল অঞ্জন চৌধুরী ঘরানার ছবি আর হচ্ছে না। অনীক দত্ত, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের ছবি বানাচ্ছেন। তাতে কি বাংলা ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি হচ্ছে?
রঞ্জিত: আপনি যে সব পরিচালকের কথা বলছেন তাঁদের ছবির কোয়ালিটি আছে। কিন্তু শুধু তাঁদের ছবি দিয়ে তো ইন্ডাস্ট্রি চলবে না। চাই মূলধারার ভাল বাণিজ্যিক ছবি। সেই সব বাণিজ্যিক ছবিতে এখন অনেক জাঁকজমক। অনেক গ্লস। কিন্তু মৌলিক সামাজিক গল্প বলার চেষ্টাটা বাড়লে ভাল হয়।
এখনও যদি অঞ্জনবাবুর মতো গল্প আরও গ্লসি ভাবে করা হয় এ কালেও চলবে। আর বাংলা ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি হচ্ছে কি না তা তো বলতে পারব না। ছবির সংখ্যা তো কমেনি।
প্রচুর, প্রচুর ছবি হচ্ছে। নানা ভাবে ছবি থেকে টাকা তোলা হচ্ছে বলেই তো শুনি। আপনি যে সব পরিচালকের নাম করছেন তাঁদের ছবি শহরে খুব ভাল চলছে। কিন্তু মফসস্ল আর গ্রামের জন্য অঞ্জনবাবুর তৈরি ছবির মতো ছবি আজও দরকার। আমি স্কুলের শিক্ষক, কলেজের লেকচারারের কাছে যতটা কৃতজ্ঞ, যাঁরা আমাকে চাল, ডাল, আলু, পটল খাইয়েছেন তাঁদের কাছেও কৃতজ্ঞ। তো এই দুই ধরনের দর্শকের জন্য ছবি তো করতে হবে মানুষের কথা ভেবে।
পত্রিকা: ইদানীং কালের কোন ছবি সব চেয়ে ভাল লেগেছে?
রঞ্জিত: ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’। এত মজা, এত আনন্দ, এত নভেলটি ইদানীং কালে আর কোনও ছবিতে পাইনি।
পত্রিকা: কোয়েল অভিনীত ছবি দেখেন না?
রঞ্জিত: দেখি তো বটেই।
পত্রিকা: কোয়েল নাকি বিয়ের পর সিনেমা করা থেকে সরে যেতে চান। এটাকে আপনি সমর্থন করেন?
রঞ্জিত: ডিসিশন ওরাই নেবে। কিন্তু সরে যাওয়ার কোনও কারণ দেখছি না। যে কাজটা করতে ও ভালবাসে, করবে না কেন? রানে আমার জামাই তো খুবই এনকারেজিং।
এত লোক যখন কোয়েলের অভিনয় দেখতে চায়। ওর সংসারের পাশাপাশি অভিনয়টাও করা উচিত। তবে শেষ সিদ্ধান্ত ওদের।
পত্রিকা: শোনা যায় প্রথমে বিয়েটা নিয়ে আপনাদের অমত ছিল খানিকটা। বরফ গলল কী করে?
রঞ্জিত: একেবারে ভুল কথা। ছেলেটিকে আমি চিনি অনেক দিন ধরে। অত্যন্ত ভাল ছেলে রানে। ওর বাবাকে চিনি পনেরো বছর ধরে। রানের খুব সুনাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে।
খুব ভদ্র আর বিনয়ী ছেলে। আমাদের কোনও আপত্তিই ছিল না। আমি চাই একটা ভাল ছেলে।
রানে কাইন্ড হার্টেড, ডাউন টু আর্থ।
আমাদের পছন্দের সঙ্গে মিলে গেছে রানের স্বভাব।
|