তপসিয়ার পরে রাজাবাজার। পরিচয়হীন মহিলার পরে জনরোষের শিকার হলেন মলিন পোশাক পরা এক যুবক।
দাবানলের মতো ছড়াচ্ছে গুজব। রাস্তায় ভবঘুরে চেহারার কাউকে দেখলে বা কোনও অপরিচিতকে হেঁটে যেতে দেখা গেলেও সেই গুজবে ভর করে ‘ছেলেধরা’ বলে চড়াও হচ্ছে জনতা। চলছে গণপিটুনি। বাদ যাচ্ছেন না মহিলা, এমনকী কোলের শিশুও।
গত ২৭ ডিসেম্বর তপসিয়ায় গণপিটুনিতে অজ্ঞাতপরিচয় এক মহিলার মৃত্যু হয়। বৃহস্পতিবার রাতে রাজাবাজারে যে যুবককে পিটিয়ে মারা হয়, তাঁর নাম মহম্মদ আলমাস। তিনি কাছের পাটোয়ারবাগানের বাসিন্দা। কাগজের খাম তৈরির কাজ করতেন। ময়লা পোশাকে তাঁকে রাতে ঘুরতে দেখে রাজাবাজারে ঘিরে ধরে জনতা। শুরু হয় পিটুনি। রাতে তাঁকে উদ্ধার করে পুলিশ আর জি কর হাসপাতালে নিলে জানা যায়, তাঁর পাঁজরের হাড় ভেঙেছে। রাতে মারা যান আলমাস।
পুলিশের দাবি, গুজবের উপরে ভর করে এ ভাবে একের পর এক আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রচারে নেমেছে তারা। শুক্রবার লালবাজারে পুলিশের যুগ্ম কমিশনার জাভেদ শামিম বলেন, “এলাকায় মাইক বাজিয়ে প্রচার করতে বলা হয়েছে। বলা হচ্ছে, গুজবে কান দেবেন না। আপনার সন্তান হারিয়ে গেলে থানায় জানান। পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।’’ কিন্তু পুলিশের আশ্বাসে যে কাজ হচ্ছে না, তা শুক্রবারেই কড়েয়া থানা এলাকায় আবার প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। তপসিয়ার ওই ঘটনার পরে ডিসি (সাউথ-ইস্ট ডিভিশন) চম্পক ভট্টাচার্যকে বদলি করা হয়। নতুন ডিসি হয়ে আসেন দেবব্রত দাস। কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি। |
শুক্রবার ভরদুপুরে কড়েয়ার ঘাসবাগান এলাকায় তিন যুবককে ঘোরাঘুরি করতে দেখে ঘিরে ধরে মারমুখী জনতা। শুরু হয় বেদম প্রহার। লোকজনের সন্দেহ, তাঁরা ‘ছেলেধরা’। বাচ্চা তুলে নিয়ে যেতে ওই এলাকায় ঘুরঘুর করছিলেন। আধ ঘণ্টা ধরে চলে গণপিটুনি। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছলে তাদের উপরও চড়াও হয় মারমুখী জনতা। ভাঙচুর চালানো হয় পুলিশ-কিয়স্কেও। পরে বিশাল বাহিনী গিয়ে উন্মত্ত জনতার হাত থেকে ওই তিন যুবককে উদ্ধার করে। তাঁদের চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এ দিন সকালে নারকেলডাঙা থানার ক্যানাল ইস্ট রোডেও আবার গণরোষের সামনে পড়েন মুন্নি নামে এক মহিলা। পুলিশের দাবি, খড়দহ থেকে তিনি এসেছিলেন রাজাবাজারে ভিক্ষা করতে। তাঁকে রাস্তার উপরে ফেলে মারধর শুরু হয় জনতা। পুলিশ এসে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলে জনতা এর পরে থানায় চড়াও হয়। ইট ছোড়া হয় থানা লক্ষ করে। পথ অবরোধও করা হয়। কিন্তু, প্রশাসনের তরফে এখনও এ বিষয়ে কোনও কড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
ঘটনার সূত্রপাত ১৮ ডিসেম্বর। তপসিয়া থানার পার্ক সার্কাস স্টেশন লাগোয়া দাড়াপাড়া থেকে সে দিন আড়াই বছরের আফসারা খাতুন নিখোঁজ হয়। আজ পর্যন্ত তার খোঁজ নেই। পুলিশের একাংশের দাবি, তাদের উপরে ভরসা হারিয়ে ফেলছেন মানুষ। আফসারার পরিবার লোকজন শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মেয়েকে খুঁজতে শুরু করেন। সেখান থেকেই শুরু হয়ে যায় গুজব।
তপসিয়ার জিনাত (১৩) ১৯ ডিসেম্বর হারিয়ে যান। পরের দিন দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে তাঁকে উদ্ধার করে এক মহিলা বাড়িতে পৌঁছতে এলে এলাকার লোক শিশুচোর সন্দেহে তাঁকেই মারে। মাঝে তপসিয়া থানার দানিশ (৯) খেলতে বেরিয়ে হারিয়ে যায়। তিন দিন পরে তিলজলার একটি পুকুর থেকে তার দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। দেহটি বিকৃত হয়ে যায় বলে পুলিশের দাবি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দানিশের কিডনি বার করে খুন করা হয়েছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, গত ছ’মাসে তপসিয়া, তিলজলার প্রায় আশিটির মতো শিশু নিখোঁজ। কোনও চক্র এদের কিডনি কেটে নিচ্ছে বলে অভিযোগ। আর সেই ধারণাকে কেন্দ্র করেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তপসিয়া, তিলজলা ও কড়েয়া। পরে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে বেনিয়াপুকুর, ট্যাংরা, রাজাবাজারেও।
পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ২১ ডিসেম্বর কড়েয়ায় একই ভাবে এক মহিলাকে স্থানীয় মানুষ মারধর শুরু করে। লালবাজারের অন্দরমহলের খবর, ওই এলাকায় যে কিছু দিন ধরেই ছেলেধরার গুজব চলছিল, তা পুলিশের অজানা ছিল না। কিন্তু সময়ে এ ব্যাপারে তারা সক্রিয় হয়নি। ২১ ডিসেম্বরের ঘটনার খবর পাওয়ার পরে থানার ওসি-র আগেই পৌঁছে যান তৎকালীন ডিসি। তবে মারমুখী জনতার তুলনায় পুলিশের সংখ্যা ছিল খুবই কম। লালবাজারের কাছে বাড়তি বাহিনী চাওয়া হলেও তা আসতে দেরি করে বলে পুলিশের একাংশের অভিযোগ। এমনকী, সংশ্লিষ্ট যুগ্ম কমিশনার ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর আগেই তাঁর ঊর্ধ্বতন অতিরিক্ত কমিশনার সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারদের অনেকের মতে এই বিষয়গুলিই বুঝিয়ে দেয়, একটি ঘটনাকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিতে পুলিশ কতটা তৎপর। |