দিল্লির যে ন্যক্কারজনক ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়েছে গোটা দেশ, তা ঘটেছিল রাতে। ভাগ্যক্রমে কলকাতায় বৃহস্পতিবার ভরদুপুরে বাসের মধ্যে একটি মেয়ের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা তত দূর গড়ায়নি। কিন্তু যা হয়েছে, তা-ও মানুষের বিচারে কম আতঙ্কের নয়। কারণ তা ঘটেছে শিয়ালদহের মতো ব্যস্ত রাস্তায়। দিনেদুপুরে ও রুটের বাসে। শুধু এই ঘটনাই নয়, বিভিন্ন স্তরে এমন ছোট-বড় ঘটনা এখন কার্যত দৈনন্দিন রুটিন। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে যে প্রশ্নগুলো উঠছে, তা হল এ কি কোনও প্রবণতা? যদি তা-ই হয়, তা হলে হঠাৎ তা বাড়ছে কেন? সাধারণ ধারণা অনুযায়ী, অপরাধের সামনে শাস্তির ভয় থাকলে তা কমে। মেয়েদের উপরে এই অপরাধ বাড়ছে কেন? এখানে কি শাস্তির ভয় কম?
সমাজের বিশিষ্টজনেদের অনেকেরই মত, শত দুষ্কর্মের পরেও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ানো যাবে, এই নিশ্চিন্ততার বোধ ছড়িয়ে গিয়েছে এক শ্রেণির মনে। তারা মনে করছে, মোমবাতি মিছিল বা প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হলেও আদতে কাজের কাজ কিছু হবে না। তাই তারা বেপরোয়া।
সাহিত্যিক বাণী বসুর কথায়, ‘‘প্রশাসন বলে বোধহয় কিছু নেই। তাই ভয়ও নেই। দিল্লি যখন তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, তখনও এখানে অবাধে মেয়েদের উপরে যৌন নিগ্রহের ঘটনা ঘটে চলেছে। যার ঠিকঠাক খাওয়া-পরার সংস্থান নেই, স্থায়ী আস্তানা নেই, সে-ও ভাবছে আর কিছু না পাই, এটা পেতে পারি।” |
মুক্তির খোঁজে: শাস্তির ভয় নেই, তাই বেড়ে চলেছে মেয়েদের যৌন নিগ্রহ। |
মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, চোখের সামনে কোনও পরিণতি না দেখতে পেলে নিশ্চিন্ততার বোধ আসবেই। এই কাজটা করলে ওই শাস্তিটা হবে এমন ভয় না থাকলে যে কেউ যখন-তখন যে কোনও কাজ করতে পারে। মনোবিদ জ্যোতির্ময় সমাজদার বলেন, “পার্ক স্ট্রিটের যে ঘটনা নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল গোটা রাজ্যে, সেই ঘটনার মূল অভিযুক্ত এখনও অধরা। এই উদাহরণটা মানুষ ভুলবে কী করে? সবাই বুঝে গিয়েছে, অপরাধ করে পার পাওয়া যায়। পরীক্ষায় ভাল ফল না করেও শিক্ষককে ভয় দেখিয়ে ক্লাসে উঠিয়ে দিতে বাধ্য করা যায়। সামাজিক ব্যবস্থা এত টালমাটাল, যা খুশি করা যায়।”
একই অভিমত সমাজতত্ত্ববিদদেরও। তাঁদের অনেকেই মনে করছেন, অবিলম্বে প্রশাসন কড়া না হলে এই প্রবণতা বাড়বে। শুধু বক্তৃতায় নয়, বাস্তবে প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁরা। সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র বলেন, “এমন অরাজকতা তৈরি হয়েছে, যার ফলে ভদ্র মানুষেরা গুটিয়ে গিয়েছেন। দাপাচ্ছে লুম্পেনরা। তারা ভাবছে ধরপাকড়ের বেশি কিছু হবে না। তাই শাস্তির ভয় নেই।”
আইনজীবী তথা রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন সদস্য ভারতী মুৎসুদ্দির কথায়, “পার্ক স্ট্রিটের ঘটনাকে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ‘সাজানো ঘটনা’ বলে অভিহিত করায় এক দিকে অপরাধীরা প্রশ্রয় পেয়েছে, আর পুলিশ-প্রশাসনের কাছেও এমন বার্তা পৌঁছেছে যে, এই ধরনের অপরাধকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা চালানোই ভাল। এটা সমাজের পক্ষে মারাত্মক।” রাজ্য মহিলা কমিশনের সভানেত্রী সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের মতে, এই প্রবণতা নতুন নয়। বরাবর এমনই হয়ে আসছে। তাঁর কথায়, “মোমবাতি মিছিল, প্রতিবাদ এক শ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছয় না। তারা প্রশাসনকে থোড়াই কেয়ার করে।” তবে কি পুলিশ-প্রশাসন ব্যর্থ? সুনন্দাদেবীর কথায়, “তা নয়, ব্যর্থতা পরিবারের। আর সমস্যা দৃষ্টিভঙ্গির। পুত্র সন্তানকে ছোট থেকে শেখানো হয়, মেয়েরা বাড়তি। তাই পরবর্তীতে তাদের মধ্যে মেয়েদের প্রতি সম্মানবোধ কাজ করে না।”
রাজ্য মহিলা কমিশনের সহ সভানেত্রী, তথা রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “পুলিশ-প্রশাসন তাদের কাজ করছে। অপরাধীরা ধরা পড়ছে, শাস্তিও হচ্ছে।” তা হলে অপরাধ ঘটছে কী ভাবে? চন্দ্রিমাদেবীর কথায়, “অনেক অপরাধী ছাড়া পাওয়ার পরে ফের একই কাজ করছে। তাদের মানসিকতায় বদল আসছে না। সেই দায় অভিভাবকদের। তাঁরা শিক্ষা দিতে পারছেন না।” |