আপাতত বরফ আরও গলল! হাসপাতালের কেবিনে মুখোমুখি মোলাকাত হল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং সিপিএমের প্রবীণ বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার। বুদ্ধবাবুর হাত ধরে রেজ্জাক বললেন, কোমরে ব্যথা হয়েই চলেছে। চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চলার জন্য তাঁর পুরনো মন্ত্রিসভার অগ্রজ সহকর্মীর কাছে অনুরোধ জানিয়ে গেলেন বুদ্ধবাবু।
চিকিৎসারত রেজ্জাকের কোমরের ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে বলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে খবর পান প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক তথা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কাছ থেকে নিয়মিতই প্রবীণ বিধায়কের শরীরের খবর নিচ্ছিলেন বুদ্ধবাবু। ব্যথা বেড়েই চলেছে শুনে বৃহস্পতিবার রাতে বুদ্ধবাবু দলীয় নেতাদের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেন, রেজ্জাককে এক বার দেখতে যাবেন। দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও তাতে আশ্বস্ত হন। কারণ, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কেন রেজ্জাককে দেখতে হাসপাতালে যাচ্ছেন না, তা নিয়ে দলের ভিতরে-বাইরে নানা জল্পনা চলছিল। রেজ্জাকের উপরে হামলার প্রতিবাদে পথে নেমে বুদ্ধবাবু এবং প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন অবশ্য ইতিমধ্যেই অনেকটা জল্পনা বন্ধ করতে পেরেছেন। এর পরে বুদ্ধবাবুর হাসপাতাল-যাত্রা দলের পক্ষে আরও স্বস্তির কারণ হল। |
হাসপাতালে আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও সুজন চক্রবর্তী। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী |
ই এম বাইপাসের ধারে বেসরকারি হাসপাতালের ৯ তলায় রেজ্জাকের কেবিনে শুক্রবার দুপুর ১টার মিনিট দশেক আগে এসে পৌঁছন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। ঘরের বাইরের সোফায় তখন বসেছিলেন প্রাক্তন সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কাছ থেকেই প্রথমে রেজ্জাকের খোঁজ নেন বুদ্ধবাবু। তার পরেই রেজ্জাকের ঘরে ঢুকে বিছানার কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কেমন আছেন তিনি? বিছানায় শুয়েই রেজ্জাক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে জবাব দেন, কোমরে বড্ড ব্যথা হচ্ছে। তবে এ দিন তাঁকে এক ধরনের বেল্ট দেওয়া হয়েছে। তিনি সেটা পরেছেন। তবে ব্যথাটা এখনও হয়েই যাচ্ছে।
এর পরে রেজ্জাকের মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়ে ঝুঁকে বুদ্ধবাবু জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছিল ওই দিন? রেজ্জাক নিচু স্বরেই গোটা ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। বুদ্ধবাবু জানতে চান, ওরা (তৃণমূূল) এমন করল কেন? রেজ্জাকের ব্যাখ্যা, ভাঙড় এলাকায় সিপিএম অনেকটা জেগে উঠেছে। আরাবুল-বাহিনীর তোলাবাজির ‘স্পেস’ (জায়গা) কমে যাচ্ছে। কাঁটাতলা ও বামনঘাটা এলাকায় ওই বাহিনী এখন ভেড়ি দখল করছে। লুঠপাট করছে। সিপিএমের সমর্থকদের বেধড়ক মারধর করছে। রেজ্জাক নিজেও সেখানে কয়েকটা প্রতিবাদ-সভা করেছেন। আরাবুল-বাহিনী একটু কোণঠাসা হয়ে গিয়েই তাঁর উপরে হামলা চালিয়েছে বলে রেজ্জাক মনে করছেন। সায় দিয়ে বুদ্ধবাবুও জানান, তাঁর কাছেও এমন খবর রয়েছে।
কতর্ব্যরত চিকিৎসক উদয়সূর্য সিংহের কাছ থেকেও রেজ্জাকের শারীরিক অবস্থার খুঁটিনাটি জেনে নেন বুদ্ধবাবু। চিকিৎসক তাঁকে জানান, চিকিৎসার সব ব্যবস্থা হয়েছে। রেজ্জাকের পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন। তার পরেই কয়েক জন চিকিৎসক রোগী রেজ্জাকের আচরণ নিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুযোগ করেন। নিষেধ না-মেনে মাঝেমধ্যেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ছেন বর্ষীয়ান সিপিএম নেতা, নিজেই চলে যাচ্ছেন বাথরুমে। কোনও কথা শুনছেন না। অথচ তাঁর যা চোট, তাতে এই সময় বিছানা থেকে ওঠানামা বিপজ্জনক হতে পারে। চিকিৎসকদের আর্জি মেনে বুদ্ধবাবু ফের রেজ্জাকের বিছানার কাছে গিয়ে তাঁকে বলেন চিকিৎসকদের পরামর্শ শুনতে। বলেন, তিনি নিজেও রেজ্জাককে অনুরোধ করছেন!
পরে ওই ঘরেই জেলা সম্পাদক সুজনবাবু, রাজ্য কমিটির সদস্য কান্তিবাবু, জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর দুই সদস্য রতন বাগচী ও রাহুল ঘোষের সঙ্গে আলোচনায় বসেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। কথা হয়, প্রতিবাদের পাশাপাশিই এলাকায় শান্তি বজায় রাখার সব রকম চেষ্টা করতে হবে। দুপুর ২টো ২৫ মিনিট নাগাদ বুদ্ধবাবুর গাড়ি হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায়। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে অতিরিক্ত কথা বলা হচ্ছে বলে গত দু’দিন ধরে চিকিৎসকেরা রেজ্জাকের নামে নালিশ করছেন। বুদ্ধবাবুর কানেও তা পৌঁছেছে। বুদ্ধবাবু চলে যাওয়ার পরেই এ দিন জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রতনবাবুর কাছে রেজ্জাকের মোবাইল ফোনটি জমা রাখা হয়েছে। সহকর্মীদের কড়া নির্দেশ, রেজ্জাককে কোনও ভাবেই সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যথেচ্ছ কথা বলতে দেওয়া হবে না! প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিদায় নেওয়ার পরে বিছানায় শুয়েই চোখ বুজে রেজ্জাকের প্রতিক্রিয়া, “সব ভাল! তবে কথা বলাটা নিষেধ!” |