গাঁধীনগরে যদি চাঁদের হাট হয়, হলদিয়ায় তবে এখনও অমাবস্যা।
‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ উপলক্ষে গুজরাতে এখন শিল্পপতি-কূটনীতিকদের মেলা। আর চার দিন পরে হলদিয়ায় ‘বেঙ্গল লিডস’। সেখানে ছবিটা কিন্তু ততটাই করুণ। ভিন রাজ্যের প্রথম সারির ক’জন লগ্নিকারী বা সংস্থার শীর্ষ কর্তা আগামী সপ্তাহে এ রাজ্যে পা রাখবেন, শুক্রবার পর্যন্ত তা একেবারেই স্পষ্ট নয়। বরং সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত সেই তালিকায় সবেধন নীলমণি গোল্ডম্যান স্যাক্স। যারা লগ্নিকারী সংস্থা নয়, বরং আর্থিক-উপদেষ্টা সংস্থা হিসেবেই বিশ্বে পরিচিত।
এমনকী, চনমনে গুজরাতে ভূমিপুত্র মুকেশ ও অনিল অম্বানী যেখানে নিজেদের আরও বেশি গুজরাতি প্রমাণ করতে নতুন লগ্নির কথা বলেছেন, সেখানে কলকাতার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ থাকলেও এ রাজ্যে লগ্নি নিয়ে কখনওই তত আগ্রহ দেখাননি কুমার মঙ্গলম বিড়লা কিংবা লক্ষ্মী মিত্তল।
আগামী মঙ্গলবার, বেঙ্গল লিডস-এ কারা আসছেন? রাজ্য সরকারে দাবি, রাজ্যের ও বাইরের প্রথম সারির প্রায় সব শিল্পপতিকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কিন্তু শুক্রবার পর্যন্ত অন্তত শিল্প দফতর বা রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম সূত্রে তেমন বড় মাপের কারও আসার নিশ্চয়তা মেলেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, লগ্নিকারীদের প্রায় সকলেই এ রাজ্যের সেই সব চেনা মুখ। টাটা গোষ্ঠীর বর্তমান চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রি,
সিআইআই-এর প্রেসিডেন্ট আদি গোদরেজ বা জিন্দল গোষ্ঠীর কর্তা সজ্জন জিন্দল হলদিয়ায় আসছেন এমন কোনও খবর এখনও নেই। দূতাবাসের স্থানীয় প্রতিনিধি ছাড়া বাইরে থেকে কারও আসার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। আবার স্থানীয় প্রতিনিধি বা অনারারি কনসাল জেনারেলদের মধ্যে অনেকেই এ রাজ্যেরই শিল্পপতি। অর্থাৎ সেই চেনা মুখ। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের প্রথম সারির সংস্থাগুলি সম্মেলনে আসার কথা জানালেও তাদের কোন স্তরের কর্তারা আসবেন, তা স্পষ্ট নয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতে গোল্ডম্যান স্যাক্সের শীর্ষ কর্তা সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় আসবেন বলেছেন। এই পরিস্থিতিতে মুখরক্ষায় মরিয়া রাজ্য সরকার ভিন রাজ্যের শিল্প-কর্তাদের আনতে বণিকসভাগুলির কাছেই আর্জি জানাচ্ছে।
এর কারণ, উদ্বোধনের পরের দিন বিভিন্ন আলোচনাসভার ভার বর্তেছে বিভিন্ন বণিকসভার উপরে। যেমন, ফিকির দায়িত্ব পরিকাঠামো এবং দক্ষতা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা, সিআইআইয়ের উৎপাদনমুখী শিল্প ও স্বাস্থ্য, বেঙ্গল চেম্বারের তথ্যপ্রযুক্তি ও পর্যটন, অ্যাসোচ্যামের ছোট ও মাঝারি শিল্প, ইন্ডিয়ান চেম্বারের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, শক্তি ও তেল, ক্যালকাটা চেম্বারের দায়িত্ব উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন সংক্রান্ত সভার আয়োজন করা। তাদের অবশ্য দাবি, সেখানে বিশ্ব ব্যাঙ্ক, ভারত ফোর্জ, সেল, আল্ট্রাটেক, অ্যাপোলো-সহ ও অন্য বড় শিল্পগোষ্ঠীর কর্তারা থাকবেন।
কিন্তু দু’মাস আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হলদিয়ায় এই শিল্প সম্মেলনের কথা ঘোষণা করলেও কেন এ বারও এ রাজ্যকে শত যোজন পিছনে ফেলে দিচ্ছে গুজরাত? শিল্পমহলের দাবি, প্রথমত, রাজ্যে লগ্নি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মন থেকে আশঙ্কা এখনও কাটেনি। বিশেষ করে জমি অধিগ্রহণ। মমতার সরকার অধিগ্রহণ না করা নিয়ে অনড়। শিল্পমহলের বক্তব্য, তা হলে বড় শিল্পের জন্য একলপ্তে জমি জোগাড় করতে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। এর মধ্যেই জমি জটে থমকে গিয়েছে কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো প্রকল্প। অন্য সমস্যাগুলি মেটানো নিয়েও রাজ্যের বিশেষ উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এ সবই তাঁদের উৎসাহে জল ঢেলে দিয়েছে। তাই আমন্ত্রণ পেলেও নানা কারণ দেখিয়ে তাঁরা এড়িয়ে যাচ্ছেন। উপরন্তু, এই শিল্প সম্মেলন নিয়ে রাজ্য ঢাক পেটাতে যতটা উদ্যোগী, তার প্রস্তুতি নিয়ে ছিটেফোঁটাও নয়। শিল্পমহলের দাবি, প্রস্তুতি শুরু হয়েছে একেবারে শেষ পর্বে, গত মাসের শেষ দিকে। এত কম সময়ের মধ্যে মেলায় স্টল দিতে রাজি হয়নি অনেক সংস্থাই। গত বারের চেয়ে এ বার স্টল তৈরির খরচ প্রায় তিন গুণ বেশি বলেও অনেকের অভিযোগ। সম্মেলনের ওয়েবসাইটেও গত সপ্তাহে যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তার সর্বত্রই রয়েছে পেশাদারিত্বের অভাব। যেমন, গত বারের মতো এ বারেও রাজ্যে গাড়ি শিল্পের কথা বলতে গিয়ে ওই ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, খড়্গপুরে ট্র্যাক্টর তৈরির কারখানা গড়ছে ট্র্যাক্টর্স ইন্ডিয়া লিমিটেড। এক শিল্প-কর্তার সহাস্য মন্তব্য, “শুধু এ রাজ্যই নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্পমহলের সবাই জানে, ট্র্যাক্টর দূর অস্ত্, ওই সংস্থাটি ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্র তৈরি করে। সেই সংস্থাকে ওই জমি দিয়েছিল রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমই!” ফলে গত বারের বেঙ্গল লিডস-এর ভুলভ্রান্তি থেকে রাজ্য কতটা শিক্ষা নিয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে শিল্পমহলের। তাদের বক্তব্য, রাজ্যের ‘শো-কেস’ প্রকল্পের প্রচারেই যদি এ ধরনের অজ্ঞতা ফুটে ওঠে, তা হলে লগ্নিকারীরা সরকারের উপর কতটা আস্থা রাখতে পারবেন? |