মোদীতে আমোদিত টাটা থেকে অম্বানী
ন্যের সাফল্যে মনের মধ্যে এমন বেদনা এর আগে কখনও হয়নি।
আজ গাঁধীমন্দিরের বিশাল প্রাঙ্গণে ষষ্ঠ ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ (বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় ‘চনমনে গুজরাত’) শীর্ষক শিল্প সম্মেলনের বিশালতায় এক দিকে শিল্পপতি, অন্য দিকে বিদেশি প্রতিনিধিদের চাঁদের হাট দেখতে দেখতে বারবার মনে হচ্ছে, গুজরাত যা পারে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গ তা পারে না কেন?
মধ্যাহ্নভোজনে টোম্যাটো আর তুলসীপাতার শোরবা খেতে খেতে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “কোনও কিছু ভাবলে সব সময় বড় করে ভাববে। থিঙ্ক বিগ।” গুজরাতের ভাডনগর গ্রাম থেকে উঠে আসা নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর মস্তিষ্কপ্রসূত এই বিশ্ব সম্মেলন দেখে বোঝা যায়, লোকটা বৃহতেরই কারবারি। মনোভাবটা হল হাতি মেরে ভাণ্ডার লুঠের। মঞ্চে মুকেশ অম্বানী থেকে রতন টাটা, কান্নাকাটি করে, হাতেপায়ে ধরেও আজ যাঁদের পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সেখানে মুকেশ মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলছেন, “নরেনভাই, আমি কিন্তু ছ’টা সম্মেলনেই হাজির থেকেছি। হান্ড্রেড পার্সেন্ট অ্যাটেন্ডেন্স।” আর রতন টাটা বলছেন, “আমি আগে একবার এই সম্মেলনে এসে বলেছিলাম, গুজরাতে যে বিনিয়োগ করবে না, সে হল স্টুপিড। আমি নিজেও তো একদা এই মহামূর্খই ছিলাম।” আর তার পরই টাটা-সংস্থার এই সদ্য প্রাক্তন কর্ণধার, গুজরাতিভাষী পার্সি রতন টাটা ঘোষণা করলেন, “আমি কিন্তু এখন আর বোকা নই। তাই ঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করছি।” টাটা কেমিক্যালস ৩৪ হাজার কোটি টাকা গুজরাতে বিনিয়োগ করবে, এ কথা তিনি ঘোষণা করলেন।
কিন্তু ঘুরেফিরে বারবার মনে প্রশ্নটা জাগছে। কেন পশ্চিমবঙ্গ পারে না? এই বৃহৎ রাজসূয় যজ্ঞটি সুচারু ভাবে সম্পাদিত। ছবির মতো নিবেদিত। সকলকে মুগ্ধ হতেই হবে। এমন নয় যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্পের কথা বলছেন না। হলদিয়াতেও বেঙ্গল লিড্স হতে চলেছে ১৫ জানুয়ারি। দিল্লির পর আগামী ফেব্রুয়ারিতে মুম্বই শহরে আবার শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনা নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সাংবাদিক বৈঠক করে আর ‘শিল্প শিল্প’ করে চিৎকার জুড়লেই যে রাজ্যে শিল্প আসবে, এমন নয়।
চনমনে ওঁরা
‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এ আপ্লুত। নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে মুকেশ অম্বানী,
অনিল অম্বানী এবং রতন টাটা। শুক্রবার গাঁধীনগরে। ছবি: পিটিআই
চনমনে গুজরাতে উপস্থিত কূটনীতিক, আমলা এবং শিল্পপতিরা একমত, যে রাজ্যে আজও রাজনৈতিক হিংসা প্রধান উপজীব্য, খোদ রাজ্যপাল, দেশের প্রাক্তন নিরাপত্তা উপদেষ্টা, রাজ্যের গুন্ডারাজ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সততার সঙ্গে ডাকলেও এই শিল্পপতিরাই কলকাতার নাম শুনে পালাবেন। শুধু তো টাটা-অম্বানী নন, কুমার মঙ্গলম বিড়লা থেকে চিন, জাপান, এমনকী ব্রিটেন, আমেরিকা পর্যন্ত গুজরাতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী। ব্রিটিশ হাইকমিশনার জেম্স বিভান তো বলেই দিলেন, গুজরাতের আর্থিক বৃদ্ধির হার চিনের থেকেও বেশি। গত দশ বছর ধরে গোটা দেশের গড় বৃদ্ধির থেকে গুজরাত তাদের আর্থিক হার বেশি রেখে চলেছে। নরেন্দ্র মোদী বললেন, “গুজরাতের বৃদ্ধির হার শতকরা দশ ভাগের থেকে বেশি।”
তবে পশ্চিমবঙ্গ চিরকাল এমন ছিল না। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময়ে পশ্চিমবঙ্গ মাথাপিছু আয়ের হিসেবে ছিল শীর্ষে। ১৯৬৪-’৬৫ সালে পঞ্জাব আর গুজরাত পশ্চিমবঙ্গকে ছাপিয়ে যায়। তার পরে কর্নাটক, তামিলনাড়ুও এগিয়ে যায়। এই ভাবে পশ্চিমবঙ্গ নেমে আসে সপ্তম স্থানে। বন্দরের দিক থেকেও পিছিয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গ ও গুজরাত, দু’টির সমুদ্র উপকূলবর্তী রাজ্য। গুজরাতে নতুন নতুন একের পর এক বন্দরের পত্তন হচ্ছে। তা নিয়ে এই সম্মেলনে প্রদর্শনী হচ্ছে। রাজ্যের মন্ত্রীরা তা নিয়ে প্রশ্নোত্তর করছেন। আর কলকাতা থেকে চলে যাচ্ছে এবিজি। সাতচল্লিশ সালের মোট বাণিজ্যের ৪৪ শতাংশ কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে হত। ষাটের দশকের শেষে সেটাই কমে দাঁড়ায় ৮ থেকে ১০ শতাংশে।
পশ্চিমবঙ্গের এই পরিণতির জন্য কেন্দ্রের নীতিকে বামেরা একচেটিয়া ভাবে দায়ী করে গিয়েছেন। আর বামপন্থীদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ উঠেছে, উগ্র শ্রমিক আন্দোলন, বন্ধ-ধর্মঘট প্রবণতা, কর্মবিমুখতার। তাই আজকের এই পরিণতির জন্য শুধুই যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারই দায়ী, এমন নয়। স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশই অবনতির পথেই গিয়েছে। সিপিএমের নেতিবাচক রাজনীতি রাজ্যকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। তবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সময় যে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের একটা চেষ্টা হয়েছিল, তা কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ থেকে নরেন্দ্র মোদী, কেউই অস্বীকার করেন না। কেন না তথ্য বলে, ২০০৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ হয়েছিল ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আর ২০১০ সালে বিনিয়োগ হয় ১০ হাজার কোটি টাকা। নন্দীগ্রামের গুলিচালনার প্রশাসনিক ব্যর্থতা পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে দিল বটে। কিন্তু বুদ্ধবাবুর শিল্পের অভিমুখ যে সঠিক ছিল, তা কিন্তু গুজরাতে উপস্থিত শিল্পপতিরা অনেকেই আজ স্বীকার করলেন। শিল্পপতিরা বলছেন, মমতা যতই শিল্পের কথা বলুন, বড় শিল্প ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে বেকারি দূর করা সম্ভব নয়। বড় শিল্প করতে গেলে বড় জমি অধিগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। ল্যান্ড ব্যাঙ্কে যে জমি রয়েছে বলে বলা হচ্ছে, তা মূলত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের অধিগৃহীত জমি। কারণ, নতুন সরকার কোনও জমি অধিগ্রহণ করেনি। দ্বিতীয়ত, ‘আরবান ল্যান্ড সিলিং অ্যাক্ট’-এর সংশোধন হলেও রাজ্য সরকার সেগুলি ‘কেস টু কেস’ অনুমোদন দেবে বলেছে। অধিকাংশ শিল্পপতি বলছেন, ‘কেস টু কেস’ মানেই দুর্নীতির সুযোগ করে দেওয়া। তৃণমূলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মেনে নীতিগত ভাবে এসইজেড-এও সায় দেবে না মমতার সরকার। ফলে বহু এসইজেড সচল হতে পারছে না। রাজারহাটে সজ্জন অগ্রবালের ফিন্যান্সিয়াল হাবের শিলান্যাস করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় অথর্র্মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ও রাজ্যের আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেব। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা তার অনুমোদন নাকচ করেছিলেন। বদলে যে হাব তিনি করবেন বলেছিলেন, সেটাও কিন্তু বাস্তবায়িত হওয়া সহজ নয়। অথচ নরেন্দ্র মোদী গত কাল উদ্বোধন করলেন ভারতের প্রথম গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল হাবের, যার নাম ‘গিফ্ট সিটি’। এটা রাজ্যের সর্বোচ্চ টাওয়ার। ২৮ তলা। ৮৮৬ একর জমিতে ৭৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। এই ফিন্যান্সিয়াল হাবের মাধ্যমে আগামী দশ বছরে দশ লক্ষ চাকরি হবে।
রাজ্যে শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তির উপদেষ্টা সৌগত রায় অবশ্য বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ, কেরলের মতো রাজ্যে জনবসতির ঘনত্ব খুব বেশি। ছোট ছোট জমি নিয়ে ছোট ছোট শিল্পের কথা ভাবতে হবে। কিন্তু ছোট শিল্পই বা কী হচ্ছে? ছোট শিল্পের নামে ডোমজুড়ের জরি শিল্পে মাথা পিছু আয় কতটা বাড়বে, কী ভাবে বাড়বে, তার কি কোনও সমীক্ষা রাজ্য সরকার করেছে? নরেন্দ্রে মোদী আজ জানিয়েছেন, তিনি ছোট উৎপাদনকারীদেরও বিশেষ ভাবে মদত দিচ্ছেন এবং চিন ও জাপানের বিশেষ সহযোগিতা পাচ্ছেন।
আসলে মূল সমস্যাটা রাজনৈতিক সংস্কৃতির। মোদী আজ বললেন, “হিংসা ও সংঘাতের আবহ ছেড়ে সকলকে নিয়ে চলার মানসিকতা দরকার। কেউ আমার শত্রু নয়। ভাইব্র্যান্ট গুজরাত কোনও একটি সম্প্রদায়, কোনও একটি জাতির নয়। সব মানুষের।”
মধ্যাহ্নভোজে নরেন্দ্র মোদীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাঙালি কি বেশি শাক্ত ধর্মে দীক্ষিত? আর গুজরাতিরা কি একটু বেশি বৈষ্ণব? তাই কি ওখানে বেশি দলাদলি, বিনয়-বাদল-দীনেশ, নকশালবাড়ি থেকে আজকের রাজনৈতিক সংঘর্ষ? তার সঙ্গে শান্তশিষ্ট গুজরাত কি মেলে না? গাঁধী এবং সুভাষের সংঘাতের এই ভাবেই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন নীরদ চৌধুরী। নরেন্দ্র মোদী হাসতে হাসতে বলেন, “এখানেও সোমনাথের শিবের মন্দির রয়েছে। তবে এখানে শিব শান্ত। তাণ্ডব নৃত্য করেন না।”
মঞ্চে উপবিষ্ট শিল্পপতিদের মধ্যে বাঙালি ছিলেন এক জনই। যিনি কলকাতাতেও ব্যবসা করছেন। অনাবাসী শিল্পপতি প্রসূন মুখোপাধ্যায়। বিমানবন্দর থেকে পুলিশ এসকর্ট দিয়ে যে ভাবে তাঁকে মঞ্চে নিয়ে আসা হল, তা দেখে তিনি নিজেই বিস্মিত। মুখ্যমন্ত্রী এবং শিল্পমন্ত্রী আলাদা আলাদা ভাবে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করে গুজরাতের বিদ্যুৎপ্রকল্প ও ফিন্যান্সিয়াল হাব তৈরির বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কেন এমন হয়, সমাজতাত্ত্বিকরা বিশ্লেষণ করবেন। কিন্তু আপাতত ছবির মতো সাজানো সুশৃঙ্খল শিল্পোদ্যোগী একটা রাজ্যকে দেখে বাঙালি হিসেবে বিষাদগ্রস্ত হওয়া ছাড়া আর অন্য কোনও বিকল্প নেই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.