চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস চলছে। প্রধান শিক্ষিকার ঘরে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ুয়ারা। সবার দৃষ্টি দেওয়ালের উপরে। এক ছাত্রী অনন্যা পালের জিজ্ঞাসা, “দিদিমণি, ওই যে গাছটা, ওটাই তো আমাদের গল্পের বইয়ের চাঁপাগাছটা না? আর চাঁপার ডালে উনিই তো বিবেকানন্দ! তাই না?” দিদিমণি বললেন, “ঠিকই বলেছ। তবে ছেলেবেলায় বিবেকানন্দের নাম ছিল নরেন।” প্রধান শিক্ষিকা পড়ুয়াদের আরও একবার দেওয়ালের দিকে তাকাতে বলে বোঝালেন “ওই যে দেখছ, উনি ভুবনেশ্বরীদেবী বিবেকানন্দের মা। ছেলেবেলায় নরেনের দস্যিপনা ঠেকাতে চান করানোর সময় ‘শিব’ ‘শিব’ বলে মাথায় জল ঢালছেন!” রামপুরহাট থানার নারায়ণপুর গ্রামের ভবানী পদ্মাবতী স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ ভাবেই স্বামী বিবেকানন্দের জীবনচর্চার বিভিন্ন দিক দেওয়ালে সিমেন্ট ও তেলরংয়ের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। উদ্দেশ্য, বিবেকানন্দের জীবনী পড়ুয়াদের চোখের সামনে তুলে ধরা। “আজ শনিবার, সারা বিশ্বে উদ্যাপিত হবে বিবেকানন্দের জন্মের সার্ধশতবর্ষ। কিন্তু বিবেকানন্দের জীবনের নানা দিক এ ভাবে পড়ুয়াদের সামনে তুলে ধরা, সত্যিই অভিনব।”
স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার ঘরের দেওয়ালে প্রায় আট ফুট উচ্চতায় রয়েছে বিবেকানন্দের জীবনীর কিছু বিশেষ মুহূর্ত। কোথাও পরিব্রাজক বিবেকানন্দ, কোথাও আবার সাধক বিবেকানন্দ গুরু শ্রী রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসে মাতৃরূপ দর্শন করছেন। এ ভাবে ১৮টি ঘরে খণ্ড খণ্ড ভাবে স্বামীজির জীবনীকে সিমেন্টের কাজের মাধ্যমে নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রামপুরহাটের মৃৎশিল্পী রবিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। শুধু বিবেকানন্দই নন, স্কুলের দোতলার একটি ক্লাসঘরে দেওয়াল জুড়ে সিমেন্ট-রংয়ের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে সহজপাঠের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের ষোলোটি মুহূর্ত। এখানে শিল্পী ব্যবহার করেছেন টেরাকোটার রং। |
প্রধান শিক্ষিকা সুমনা দাস জানালেন, ২০১২ সালের প্রথম দিকে সর্বশিক্ষা মিশন থেকে পাওয়া ৪ লক্ষ ৩৪ হাজার টাকায় প্রধান শিক্ষকের ঘর-সহ শৌচালয় তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও ওই টাকায় স্কুলের সীমানা প্রাচীর পড়ুয়াদের খেলার জন্য স্লিপও তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে বিবেকানন্দের জন্মের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর জীবনের নানা মুহূর্তকে ফুটিয়ে তোলার ব্যবস্থা করা হয়। সহকারী শিক্ষক বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত ঘোষ, মিরু মারান্ডিরা বলেন, “পড়ুয়াদের মধ্যে বিবেকাননন্দকে নিয়ে আগ্রহ বাড়ানোর জন্য স্কুলে একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত গড়ে তোলার লক্ষ্যেই আমাদের এই প্রয়াস।” নারায়ণপুর গ্রামের বারোয়ারিতলায় এই প্রাথমিক স্কুলটি গড়তে জমি দিয়েছিলেন গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ধীরেন মণ্ডল। ৭৬ বছরের বৃদ্ধ ধীরেনবাবু বললেন, “সত্যিকারের শিক্ষা লাভে এ ভাবেই পড়ুয়ারা মনীষীদের সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতে পারবে।” অভিভাবক অনিল মণ্ডল, সর্বেশ্বর মণ্ডলের বিশ্বাস, “শিশুদের মানবিক চরিত্র বিকাশে স্কুলের এই উদ্যোগ অনেক কাজে আসবে।” গ্রামশিক্ষা কমিটির সভাপতি তথা স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান জয়দেব চৌধুরীর কথায়, “এ ধরনের উদ্যোগ অন্য স্কুলগুলিতেও হওয়া উচিত।” রামপুরহাট পশ্চিম চক্রের অবর স্কুল পরিদর্শক অনঙ্গমোহন পাত্র বলেন, “শুধু ওই স্কুলটিই নয়, যেখানে নতুন ভবন বা কক্ষ তৈরি করা হচ্ছে, সেখানেই এই ধরনের কাজ হচ্ছে। তবে এই কাজটি অবশ্যই আলাদা ভাবে প্রশংসার যোগ্য।” |