নিজস্ব সংবাদদাতা • ফালাকাটা |
উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চলে ট্রেনের ধাক্কায় হাতির মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। সত্তর দশক থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ওই লাইনে অন্তত ৬০টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। বন দফতরের তথ্য তাই-ই বলছে। রাজ্য তো বটেই, কেন্দ্রের পরিবেশ মন্ত্রকও ওই ঘটনা নিয়ে বারেবারেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রেলের তরফেও উদ্বেগের বহর কম নয়। হাতি-ট্রেন সংঘাত ঠেকাতে কী করণীয় তা ঠিক করতে এ যাবৎ ৫০টি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। সুপারিশের সংখ্যাও সমপরিমাণ। কমবেশি বরাদ্দও হয়েছে ৫ কোটি টাকা। বৈঠক, সুপারিশের পরে কাজের কাজ কতটা হচ্ছে তা নিয়ে সব মহলেই প্রশ্ন রয়েছে। রাজ্যের বন দফতর, কেন্দ্রের রেল ও পরিবেশ মন্ত্রকের মধ্যে তা নিয়ে যেন অন্তহীন ঠেলাঠেলি চলছে। পরিবেশপ্রেমী ও হাতি বিশেষজ্ঞরা অনেকেই এমনই মনে করছেন। যেমন হস্তি বিশারদ ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী যে পরামর্শ দিচ্ছেন তা বাস্তবায়িত করতে কোনও পক্ষ কাজের কাজ করেনি বলে অভিযোগ। ধৃতিকান্তবাবুর বক্তব্য, “জঙ্গলে খাদ্য বাড়ানো দরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে অনুমতি নিয়ে বেশ কিছু বুনোকে ধরে কুনকি প্রশিক্ষণ দিয়ে বন দফতরের কাজে লাগানো অত্যন্ত প্রয়োজন।”
পাশাপাশি, উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চলে বাসস্থানের পরিধি কমেছে জন্য হাতিরা বাইরে বেরিয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন হাতি বিশেষজ্ঞ পার্বতী বড়ুয়া। তিনি বলেন, “হাতির সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাসস্থানের টান পড়েছে। বিষয়টি বন দফতর দেখছে বলে মনে করি। হাতির মৃত্যু ঠেকাতে ট্রেন চলাচলের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখা জরুরি।”
|
গত সাত বছর ধরে হাতি ও মানুষের সংঘাত নিয়ে কাজ করছে আলিপুরদুয়ারের পশু প্রেমী সংগঠন রোভার্স অ্যান্ড মাউন্টেনিয়ার্স ক্লাব। ডুয়ার্সের রেলপথে ঘনঘন হাতির মৃত্যুর ঘটনা ঠেকাতে বনাঞ্চলগুলির উপর দিয়ে যাওয়া রেলপথগুলিতে উড়ালপুল তৈরির দাবি করেছে ওই সংস্থা। অথচ ২০১০ সালে ট্রেনের ধাক্কায় একযোগে ৭টি হাতির মৃত্যুর পরে তৎকালীন কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ ডুয়ার্সের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হাতির করিডর চিহ্নিত করে অন্তত ৭০টি জায়গায় ওয়াচ টাওয়ার তৈরির প্রস্তাব দেন। ১০টি ওয়াচ টাওয়ার তৈরির জন্য কেন্দ্র টাকা দেবে বলে ঘোষণা করেন। সে জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। ভাবা হয়েছিল, ওই টাওয়ারে রেল মন্ত্রক ও বন দফতরের যৌথ পাহারা হবে। হাতির পালকে লাইনের ধারে দেখলে কনট্রোল রুমে জানিয়ে ওই লাইনে চলাচলকারী ট্রেনের চালক-গার্ডকে গাড়ি ধীরে চালাতে বলা হবে। বাস্তবে সেই কাজ হয়নি।
বন দফতর ও রেল সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে ডুয়ার্সের বনাঞ্চল দিয়ে যাওয়া রেলপথটি ১৯৭৪ সাল থেকে মিটার গেজ থাকাকালীন সময়ে ২৮ বছরে ট্রেনের ধাক্কায় ২৭টি হাতি মারা যায়। অথচ ২০০৪ সাল থেকে গত আট বছরে ৩৩টি হাতির মারা যায়। ট্রেন লাইন মিটারগেজ থাকাকালীন সারা দিনে ৫ জোড়া ট্রেন চলত। এখন ওই পথে ৬ জোড়া যাত্রিবাহী ট্রেনের পাশাপাশি চলছে মালগাড়ি।
বস্তুত, লাইনের গেজ পরিবর্তন করা হলে যে ট্রেনের ধাক্কায় হাতির মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে বলে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল ডবলুডবলুএফ। সংস্থার বক্তব্য ছিল মিটার গেজের তুলনায় ব্রড গেজ লাইনে ট্রেনের গতিবেগ বেশি থাকে। তাই তাতে হাতির মৃত্যু বৃদ্ধি পাবে। ওই কারণে রেলপথের গেড পরিবর্তনের বিরোধিতা করে ২০০১ সালে হাইকোর্টে মামলা করে পরিবেশপ্রেমীদের এক সংগঠন। বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য তিন জনের একটি কমিটি গঠনের আদেশ দেয় আদালত। ওই সময় বিশেষজ্ঞদল আদালতকে কয়েকটি প্রস্তাব দেয়। ওই প্রস্তাবে রেলপথের যে এলাকা পার হয়ে হাতি এক জঙ্গল থেকে অন্য জঙ্গলে যাতায়াত করে এমন চারটি করিডরের উল্লেখ করা হয়। বলা হয় ওই করিডরে ট্রেন ধীর গতিতে চালাতে হবে। হুইসেল ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়াও আরও ১০টি প্রস্তাব ছিল।
গেজ পরিবর্তনের বিপক্ষে মামলার আবেদনকারী তৎকালীন ডবলুডবলুএফ-এর পশ্চিমবঙ্গের ডিরেক্টর শক্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মিটার গেজ রেল পথে ডুয়ার্সের মানুষ স্বচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতেন। ফালাকাটা হয়ে বিকল্প রেলপথ রয়েছে। সেখানে ডবল লাইন করে বেশি সংখ্যক ট্রেন চালানো যেত। আমাদের আশঙ্কাই ঠিক হল। যে হারে হাতি মারা যাচ্ছে তাতে আমরা চিন্তায় আছি।” গত ৫ জানুয়ারি রাজাভাতখাওয়ার পাশে দুর্ঘটনায় ঝাঝা এক্সপ্রেসের ধাক্কায় ৩টি হাতির মৃত্যু ও দুটি হাতির জখম যে এলাকায় হয় রেলকর্তাদের দাবি সেটা হাতির করিডর নয়। রেল কর্তৃপক্ষের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের জনসংযোগ আধিকারিক সিতু সিংহ হাজং বলেন, “যে এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটে তার সবটাই করিডর নয়। সেখানে হাতির আনাগোনা আছে বলে বন দফতরের থেকে আমাদের কাছে আগাম সতর্কতাও ছিল না।”
রাজ্য বন দফতর কিন্তু করিডরেই দুর্ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করছে। দুই প্রাক্তন বনমন্ত্রী যোগেশ বর্মন ও অনন্ত রায় রেলের ভূমিকা নিয়ে বারেবারেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বর্তমান বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন রেলের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। হিতেনবাবুর আশা, “মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে রেলকে সুপারিশ মেনে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করবেন।” শিলিগুড়ির পরিবেশ প্রেমী সংগঠন ন্যাফ-এর মুখপাত্র অনিমেষ বসু জানান, তাঁরা বহুদিন ধরে ট্রেনের গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ বাধ্যতামূলক করানোর দাবি করছেন। অনিমেষবাবু বলেন, “রেলকর্তারা আশ্বাস দেন। তার পরেও দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে।” কলকাতার পরিবেশপ্রেমী সংগঠনের কর্তা হীরক নন্দী জানান, তাঁরা ফের হাইকোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছেন। |