গৌরব বিশ্বাস • হোগলবেড়িয়া |
মাটি ফিরল।
তবে আর নয়, বিএসএফ ক্যাম্প থেকে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেই অজিতবাবু বলছেন, “বাবাঃ, যা গে ক’দিন। এ বার আর যাই হোক, বাড়িটা আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ফেলতে হবে।” তার গলকম্বলে হাত বোলাতে থাকেন হোগলবেড়িয়ার দুর্লভপুর গ্রামের অজিত বিশ্বাস। “নিজের জন্য কোনওদিন থানা, পুলিশ-আদালত করতে হয়নি। কিন্তু মাটিকে বাড়ি ফেরাতে গিয়ে জীবনটাই শেষ হয়ে যাচ্ছিল!” গলায় পেঁচানো মাফলার দিয়ে এই পৌষেও কপালের ঘাম মোছেন তিনি।
অজিতবাবুর প্রিয় দু’টি বলদ, লাল ও মাটি। গাঁয়ের লোকে বলে অজিতের দুটি পাঁজরা যেন! সংসারের জোয়াল টানতেও তাঁর সব থেকে বড় ভরসা হালের ওই দু’টি বলদ। সাধের লাল-মাটিকে যাতে কেউ চুরি করে সীমান্ত উজিয়ে ওপারে নিয়ে যায় সে জন্য এই শীতেও বারান্দাতেই শুতেন অজিতবাবু। তা শেষরক্ষা হল কোথায়! গত ১২ ডিসেম্বর রাতে গোয়াল থেকে লাল আর মাটি সেই খোয়া গেল। রাতেই থানায় ছুটেছিলেন অজিতবাবু। শীত রাতে পুলিশের সাইকেলের পিছনে বসে সীমান্ত ছুঁয়ে কম খুঁজেছিলেন তাদের? কিন্তু কোথায় লাল-মাটি!
পর দিনই অবশ্য খবর মিলেছিল, কাছাড়িপাড়া সীমান্তে একটা বলদ ধরা পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটেছিলেন অজিতবাবু। যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই। তাঁর সাধের মাটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। বিএসএফ জওয়ানের কাছে হাত জোড় করে কত কাকুতি মিনতি, “স্যার এ’টা আমার জান। দেখবেন এক বার ডাকলেই ও তাকাবে। এই মাটি...মাটি”, মাটি তাকায়। কিন্তু সীমান্তরক্ষীর মন ভেজে না। সাফ জানিয়ে দেন, দু’টো বলদ নিয়ে সীমান্ত পার হচ্ছিল। তাদের তাড়া করে এই একটিকেই উদ্ধার করতে পারা গিয়েছে। তার মানে লাল হারিয়ে গিয়েছে পদ্মার চর পেরিয়ে সেই কোন গাঁয়ে। তারপর... আর ভাবতে পারেন না অজিতবাবু। দু-চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। |
নিশ্চিন্ত মাটি। ছবি: কল্লোল প্রামাণিক। |
মাটিকে নিয়ে আর বাড়ি ফেরা হয়নি। মুখ ঝামটা খেয়ে ক্যাম্প থেকে ফিরে আসেন তিনি। ততক্ষণে পাচারের জটিল জালে জড়িয়ে গিয়েছে মাটি। অতএব, বিএসএফ থেকে কাস্টমস তারপর আরও আরও কত কী! আইনের গেরোয় ‘সিজার লিস্টে’ ঠাঁই পেয়ে মাটি হারিয়ে যায় কোথায়।
কাস্টমসের মাল। দিন কয়েক পরে তাই নিলামে ওঠে মাটি। অজিতবাবু বলেন, “আমি লেখাপড়া জানি না। আইনের এত সব মারপ্যাঁচও অজানা। ফলে এ সব শুনে তো আমার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। জানতে পারলাম নিলামে ওর যা দাম উঠবে তা আমি দিতেই পারব না।”
কিন্তু নিজের বলদকে নিজেই দাম দিয়ে কিনতে হবে! থানায় ডায়েরির পাশাপাশি আদালতে ছুটেছিলেন অজিতবাবু। তেহট্ট মহকুমা আদালতের আইনজীবী আসান আলি শেখ বলেন, “অজিতবাবুর গরুর বিষয়টি এসিজেএমের আদালতে তোলা হয়েছিল। গত বুধবার বিচারক করিমপুর কাস্টমসের ওসিকে ওই গরু অজিতবাবুকে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।” সরকার পক্ষের আইনজীবী রামপ্রসাদ মণ্ডলও বলেন, “বিচারকের নির্দেশ, কী আর করা যাবে। বলদ এখন অজিতবাবুর।”
করিমপুর কাস্টমসের ওসি চন্দ্রশেখর দাস বলেন, “বিএসএফের হাতে কোনও গরু ধরা পড়লে সেটা আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তারপর নিয়মমাফিক আমরা নিলাম করি। এ ক্ষেত্রেও সেটাই করা হত। কিন্তু অজিতবাবু ওই গরুটি তাঁর বলে দাবি করে আদালতের দ্বারস্থ হন। তারপর আদালতের নির্দেশেই ওই বাজেয়াপ্ত গরু আমরা অজিতবাবুর হাতে তুলে দিয়েছি।”
গত কয়েকদিনে বিশ্বাস পরিবারে রীতিমতো ঝড় বয়ে গিয়েছে। প্রিয় দু’টি বলদ, লাল আর মাটির শোকে এই ক’দিন নাওয়া খাওয়া একপ্রকার বন্ধই করে দিয়েছিলেন অজিতবাবু। তাঁকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা। স্ত্রী ফোনাইদেবী বলেন, “গরু-বাছুর নিয়েই মানুষটা সারাদিন থাকেন। বলদ দু’টো চুরি যাওয়ার পর মানুষটা নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়েছিল। মাটি ফেরায় ওঁর সঙ্গে আমাদেরও স্বস্তি ফিরেছে।”
জাবনা থেকে মুখ তুলে চুপ করে থাকে মাটি। তার গভীর চোখ বুঝি লালকে খোঁজে! |