হুল্লোড় |
নতুন বাঙালির জন্য নতুন গান
কথার রং লাল? না কি নীল? এসে যায় কি? গীতিকাররা নতুনের খোঁজে
শব্দের ব্যবহার বদলে দিচ্ছেন। কেন? উত্তর খুঁজেছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
• ‘যে ভাবে জলদি হাত মেখেছে ভাত/ নতুন আলুর খোসা আর এই ভালবাসা’
• ‘তারা কবে ছেড়ে গেছে বন্দর/ আমি পাল্টে নিয়েছি রিংটোন’
•
‘দূরের স্টিমার, আলোর তারিখ, ভিজে মানুষ কী যে কখন... বলা বারণ’
•
‘পাতালপুরীর ভিতর/ বয়াম ভর্তি আতর/ আতর মেখে হচ্ছে বড়/ মা মাসির গতর’
মানে বই নিয়ে বসলে হয়তো ঠোক্কর খেতে হবে। নতুন আলুর সঙ্গে ভালবাসার কী সম্পর্ক? আলোকবর্ষ বিজ্ঞানে বা বাংলা গানে নতুন নয়। তবে ‘আলোর তারিখ’য়ের উৎস কবে বা কখন সেটা হয়তো বলা বারণই থেকে যাবে টলিউডে। যেমন নিষেধ থাকবে জানতে কোন সে বিউটিশিয়ান জিনি কানে কানে বলে দেবেন আতর মেখে স্বাস্থ্যবতী হওয়ার গোপন রহস্য।
তবে প্রচলিত বাংলা গানের গীতিকারদের এই নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। ও দিকে সম্প্রতি সারা দেশ তোলপাড় হয়ে গেছে ‘কিউ কি ম্যায় হু বলাৎকারি’র শালীনতার বিচার করতে গিয়ে। শোনা যাচ্ছে এফ আই আর পর্যন্ত করা হয়েছে পঞ্জাবি র্যাপার হানি সিংহের বিরুদ্ধে। হানি জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ওই লিরিকস লেখেননি। ভুল ভাবে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। তর্ক-বিতর্কের ঝড় উঠেছে চায়ের ভাঁড়ে। আর তার মধ্যে চলছে বাংলা গানের লিরিকস্ নিয়ে আলোচনা।
কেন ব্যবহার করা হচ্ছে এমন সব লিরিকস? যার কোনও মানে নেই। যদিও প্রত্যেকটি অ্যাবস্ট্রাক্ট ফ্রেজ সামগ্রিক ভাবে একটা আবেশ তৈরি করে। যে কারণে আজ এই গানগুলো এত জনপ্রিয়। বাংলা গানের মধ্যে কবিতার কাপলেট কেন খুঁজছি
আমরা? এই সব নতুন শব্দ বাছাই-এর পিছনে কি আরও কোনও গভীর দর্শন লুকিয়ে রয়েছে? |
‘অটোগ্রাফ’ ছবিতে নন্দনা সেন ও ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত
|
শ্রীজাত
আমি কবিতার মানুষ। তাই আমার গানের কথার মধ্যে কবিতার লাইন ফিরে ফিরে আসে। এই ‘মানে না থাকা লিরিকসের ব্যবহার’য়ের দোষে আমিও অনেক সময় দুষ্ট। আলাদা করে হয়তো শব্দগুলোর কোনও মানে হয় না। অনেক সময় ফ্রেজগুলো বেশ অ্যাবস্ট্র্যাক্ট হয়ে যায়। যাঁরা নিজের মতো করে মানে খুঁজে পান, তাঁদের ভাল লাগে শব্দের ব্যবহার। আর যারা সেটা খুঁজে পান না, তাঁরা হয়তো অর্থ নিয়ে প্রশ্ন করেন। |
কেন লিখলাম?
যেমন অনেকেই প্রশ্ন করেছেন আমাকে ‘চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন’ গানটার কথা নিয়ে। অন্তরার কিছু শব্দ চয়ন অনেকের কাছেই বেশ অ্যাবস্ট্র্যাক্ট লেগেছে। যেমন এই লাইনটা: ‘পোষা বালিশের নীচে পথঘাট, যারা সস্তায় ঘুম কিনত’। পোষা শব্দটা সাধারণত ব্যবহার করা হয় প্রাণীদের ক্ষেত্রে। আমার মনে হয়েছিল যে, পোষা শব্দটার ব্যবহারও পাল্টেছে অনেকটা। তাই এই প্রয়োগ। একজন মানুষ যখন জীবন থেকে চলে যায়, তখন তার জন্য আর আলাদা করে কিছু রাখতে হয় না। তাই রিংটোনটাও আর পাঁচটা মানুষের ভিড়ে মিশে যায়। সেটা বোঝাতেই লিখেছিলাম পরের লাইনটা, ‘তারা কবে ছেড়ে গেছে বন্দর/ আমি পাল্টে নিয়েছি রিংটোন’।
আরও একটা গান লিখেছিলাম, ‘জানি দেখা হবে’ ছবির জন্য। শ্রেয়া গেয়েছিল। ‘ঘুম ভেঙে কিছু মেঘলা দিনও হোক/ ওড়নার পাশে সেফটি পিনও হোক/ বিকেলের নাম অ্যাল পাচিনো হোক/ খেয়ালি ছাতে!’ অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন ‘বিকেলের নাম অ্যাল পাচিনো হোক’য়ের মানেটা কী? সত্যিটা হল এটার মানে আমি নিজেও সে ভাবে বলতে পারব না। এটা একটা বিশেষ অনুভূতি। এটা না লিখে আমি বিকেলের নাম ভ্যান গগ-ও লিখতে পারতাম। অনেকের কাছেই শব্দগুলোর একটা অর্থ আছে। ২৫ বছর আগে এটা লিখলে হয়তো অনেকেই রিলেট করতে পারতেন না। সুমনদার গান আমাদের অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। সুমনদা লিখেছিলেন ‘তোমার কথার রংটি লাল, হলুদ সবুজ হালকা নীল’। বাংলা সাহিত্যে শুধুমাত্র সুকুমার রায়ের কবিতায় এ রকম শব্দের ব্যবহার পাওয়া যেত। আজ তাই শব্দ ব্যবহার করার স্বাধীনতা আমাদের অনেক বেশি।
বিদঘুটে লিরিকস
আমি মনে করি না যে, যে গান আমি পছন্দ করি না সেগুলো খারাপ। একবার নচিকেতার একটা গানে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ শব্দের ব্যবহার শুনে চমকে গিয়েছিলাম। পরে বুঝেছি গানটার জন্য সেটা খুব জরুরি। বরং বলা যেতে পারে, ব্যবহারের ভাল মন্দ হয়, শব্দের নয়।
লিরিকস ভাল বা খারাপ এই বিশ্লেষণে না গিয়েও শুধু এটুকু বলতে পারি যে, ‘আমি হলাম রোমিও/ লেডি কিলার রোমিও/ পাক্কা প্লে বয় রোমিও’র মতো গান আমি লিখতে পারব না। সেটা আমারই সীমাবদ্ধতা।
|
অনুপম রায়
আমি এমন ভাবে গান লিখব না যেখানে আমাকে শ্রোতাদের বলে দিতে হবে, এটার মানে এটা। ২০১৩ সালে বসে আমি নিশ্চয়ই এমন কোনও শব্দ ব্যবহার করব না যেটা বহুলচর্চিত। যেমন ‘চাঁদমুখ’ শব্দ আজ ব্যবহার করলে পুরোনো স্টাইলটারই অনুকরণ করা হবে। হাজার হাজার কবি চাঁদের সঙ্গে প্রেমিকার মুখের তুলনা করেছেন। আমি যদি সেই এক জিনিস একই ভাবে লিখি, তা হলে আর নতুনত্ব কোথায়! |
কেন লিখলাম
আমার লেখা একটা গান, ‘যে ক’টা দিন তুমি ছিলে পাশে’। সেখানে ছিল: ‘যে ভাবে জলদি হাত মেখেছে ভাত/ নতুন আলুর খোসা আর এই ভালবাসা’। এই গানটা যে মুহূর্তে লেখার কথা ভেবেছি, তখন আমি আলু চটকে খাচ্ছিলাম। শীতকালে নতুন আলু ওঠে। খোসা সমেত রান্না করা হয়। সেই দৃশ্যগুলো মনে পড়ছিল যখন আমি গানটা লিখি।
‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবির ‘একবার বল নেই কেউ তোর নেই’ গানটাও বেশ জনপ্রিয়। গানটায় ছিল: ‘...সেখানে ছুটব ভাবি, গিলব, গল্পের ভুল হবে বানান/ এই বুঝি ফস্কাল হাত, আর কালো রাত করে সময় গেল আয়োজনে...’
অনেকের কৌতুহল যে ‘রাত’-কে কিছু করা যায় কী করে! আমরা তো ‘ডুয়িং আ নাইট’ বলি না কোনও দিন। তবে আমি যথেষ্ট স্বাধীনতা নিয়েই ‘রাত করা’কে ক্রিয়া হিসাবে ব্যবহার করেছি। এটা সম্ভব হয়েছে নতুনত্ব খোঁজার তাগিদে। আর আছে নিজস্ব একটা স্টাইলের ছোঁয়া।
‘চন্দ্রবিন্দু’র কাজে অনেক সময় র্যানডমনেস আর ক্যাওস পাই। সেটা অনুপ্রেরণা দেয়। যেমন চন্দ্রিলদা’র ‘এবড়ো খেবড়ো রং’-এর লাইনগুলো: ‘তাজা লোফারের শিসের বিষ/ উঠে গিয়ে কেন্ন কে পিষে দিস/ তারও কাক স্নানের প্রহর হবে অঝোর।’
বিদঘুটে লিরিকস
ছোটবেলায় একটা গান শুনেছিলাম: ‘এত দুঃখ পেলাম আমি মাপার মতো নেইকো ফিতে’। এই অলঙ্কারে সূক্ষ্মতার অভাব খুঁজে পেয়েছি আমি। আজকাল ‘শব্দ নিয়ে খেলা’ করব বলেই করলে সেটাতে কোনও মজা নেই। মানুষ বুঝতে পারে কোনটা আসলে ‘ওয়ার্ড প্লে’, কোনটা চমক। নাম বলব না তবে খুব সহজেই পার্থক্য করা যায় ‘লিরিকস’-এর কোন ব্যবহারটা বুদ্ধির পরিচয়, কোনটা ন্যাকা, আর কোনটা একেবারেই সস্তা।
|
‘অন্তহীন’ ছবিতে রাধিকা আপ্তে
|
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
ছোটবেলায় শুনেছিলাম ‘পৃথিবী হারিয়ে গিয়েছে মরু সাহারায়’। কিছুতেই কোনও মানে খুঁজে পাইনি। তবু মনে আছে যে গানটা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
বাংলা গানের লিরিকস অনেক রিফাইনড্ হয়েছে কবীর সুমনের হাত ধরে। আমাদের লেখার মধ্যে জয় গোস্বামী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ছায়া আছে। আজ যখন লিখি, চেষ্টা করি আধুনিক হতে। |
কেন লিখলাম
‘অন্তহীন’য়ের গান: ‘যাও পাখি বলো, হাওয়া ছলো ছলো, আবছায়া জানালার কাঁচ/ আমি কি আমাকে হারিয়েছি বাঁকে রূপকথা আনাচ কানাচ’। এটা একটা আধুনিক প্রেমের গান। পাখির যে চিত্র তা একটা পুরোনো ঘটনা মনে করায়। এর আগে অনেক সময় ‘পাখি উড়ে যাওয়া’র প্রতীকটা ব্যবহার করা হয়েছে প্রেমের গানে। ‘হাওয়া ছলো ছলো’ কথাগুলোর মধ্যে একটা অভিমান লুকিয়ে আছে। যেটার আভাস পাওয়া যায় ‘আবছায়া জানালার কাঁচ’ ফ্রেজের মধ্যেও। যে প্রেমে পড়েছে সে না পাওয়ার অভিমান থেকেই বলতে পারে: ‘আমি কি আমাকে হারিয়েছি বাঁকে’।
আবার ‘অপরাজিতা তুমি’ ছবির ‘রূপকথারা’ গানটিতে আছে: ‘রূপকথারা চুপকথারা ফুরফুরে এক রোদের জন্মদিন’। কেন লিখলাম ‘এক রোদের জন্মদিন’? ‘এক রোদ’ আবার হয় না কি? হয় না। এখানে লিরিক্যালি ব্যবহার করা হয়েছে শব্দগুলোকে। রোদ তো আসলে বন্ধুত্ব। তার পরের লাইনেই লিখেছি ‘আলটুসি ক্যান্টিন’। ‘ক্যান্টিন’ শব্দটির সঙ্গে হয়তো ‘আলটুসি’ শব্দটি সচরাচর কেউ ব্যবহার করবে না। একটা নরম প্রেমে পড়ার মুহূর্তকে ধরার চেষ্টা করেছি আমরা। এখানে মনে পড়ে যায় শ্রীজাত’র ব্যবহার করা ‘হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল...’ লাইনটা। কী সুন্দর ‘নস্টালজিয়া’ শব্দটা ভেঙে শ্রীজাত ওর কলমের মুন্সিয়ানাটা দেখিয়েছে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা ছবি যেখানে নস্টালজিক হৃদয় যেন টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে।
বিদঘুটে গান
অদ্ভূত শুনতে লাগে ‘খোকাবাবু যায়, লাল জুতো পায়’। ননসেন্স লিরিকস হতেই পারে। যেমন ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ আমার ভীষণ প্রিয়। লাইনটা ব্রিলিয়ান্ট। লিরিক্যালি ভীষণ উত্তীর্ণ। তবে এই উত্তরাধিকার কিন্তু ‘খোকাবাবু’র মধ্যে পাই না। সেখানে লিরিকটা নড়বড় করছে।
|
শিলাজিৎ
মনে আছে আমার বাবার লেখা আমার প্রথম অ্যালবামের গানের লাইন: ‘প্রেম যেন ওয়েসিস তাকলামাকান’। লাইনটা শুনে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় জিজ্ঞেস করেছিলেন এই ‘তাকলামাকান’-টা কী? আমি বলি ওটা একটা মরুভূমির নাম। আসলে গীতিকারের কাছে সব সময় লাইনগুলোর একটা অর্থ থাকে। লালনের সেই পুরনো গানের লাইন মনে পড়ে যায়: ‘ছয় মাসের এক কন্যা ছিল/ নয় মাসে তার গর্ভ হল/ আবার এগারো মাসে তার তিনটি সন্তান/ কোনটা করবে ফকিরি?’ লালনের কাছে নিশ্চয়ই এই কথাগুলোর একটা মানে ছিল। গানটা যদিও আমার খুব প্রিয় তবে কোনও মানে খুঁজে পাইনি। |
কেন লিখলাম
একটা গান লিখেছিলাম ‘পাগল’ বলে। প্রশ্ন ছিল কেন লিখেছিলাম ‘পাতালপুরীর ভেতর/ বয়াম ভর্তি আতর/ আতর মেখে হচ্ছে বড়/ মা-মসিমার গতর/ গতর খাটায় মুটে/ যত রাত্রিবেলা জুটে/ আর কয়েক কিলো পেঁপের রস/ পিঁপড়ে খেল খুঁটে’? গানের নাম ‘পাগল’ বলেই আমি এই রকম ইমেজ তৈরি করেছিলাম? না। একজন পাগল একটা ‘বিউটি পার্লার’ নিয়ে কল্পনা করছে। সেটা বোঝানোর জন্যেই এভাবে লেখা।
‘বাই বাই ব্যাংকক’ ছবির জন্য লিখেছিলাম: ‘শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট কর্মনিষ্ঠ কাম কামরায়/ হন্তদন্ত ব্যস্তমন্ত কেষ্ট বিষ্টু কষ্ট ধান্ধায়/ জ্যান্ত তবু জ্যান্ত নয় স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন হাত বাড়ায়/ মিছিমিছি কানামাছি আয়না ভাঙে কার লজ্জায়?’
প্রত্যেকের মধ্যেই একটা কামনা কাজ করে। আমরা সবাই দৌড়চ্ছি কাজ করতে। তবে আয়নার সামনে দাঁড়ালে বোঝা যাবে আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে অন্য মানুষের বাস। কে সেটা দেখে লজ্জা পাবে? আয়না না আমি?
বিদঘুটে গান
আমাদের সেই সাহস আছে ছিটকে যাওয়ার মতো লিরিকস লেখার? অনেকে বলেছেন যে আমার গান শুনে বমি পায় তাদের। ‘অ্যান্টেনা’ গানটা নিয়ে গালমন্দ শুনেছি। কেন লিখলাম ‘একটা জিন্স, একটু গ্রাস, শান্ত বাঘ বারো মাস’? তবে আমি কোনও সমসাময়িক বাংলা গানের লিরিকস নিয়ে এটা বলতে পারব না। |
|