|
|
|
|
বাবা জ্ঞান দিয়ো না |
স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের চেনা ছকের
বাইরে জগৎটাকে ভাবতে চাই
বললেন সোহিনী সেনগুপ্ত। মুখোমুখি সংযুক্তা বসু |
বাংলা সিনেমায় আপনি এই সময়কার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। অনেকেই এই কথা বলে থাকেন।
এই সব কথা শুনলে দায়িত্ব বেড়ে যায়। চাপে পড়ে যাই। আমার অভিনয় শেখা থিয়েটার থেকেই। থিয়েটারটাই মন দিয়ে করার চেষ্টা করি। মানুষের প্রত্যাশা সব সময়ই একটা চাপ তৈরি করে।
রোগা হওয়ার জন্য সাঁতার শিখছিলেন। আরও রোগা হলেন না কেন?
সাঁতার কাটা শীতকালে বন্ধ। নিয়মিত জিমে যাই। আগের থেকে অনেক ওজন কমেছে। খেতে খুব ভালবাসতাম। সেই শখেও লাগাম টেনেছি। এখন স্টু খেয়ে দিন কাটছে। পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আর নন্দিতা রায় আমি কী খাচ্ছি না খাচ্ছি তা নিয়ে সব সময় পেছনে পড়ে আছে যাতে আমি রোগা হই। আমার মা-ও আমার রোগা হওয়ার ব্যাপারে খুব সতর্ক।
এত ভাল চরিত্রাভিনেতা। এত মিষ্টি মুখ। রোগা হলেই নায়িকা হতে পারতেন কিন্তু....
না। চরিত্রাভিনেতাই থেকে যাব হয়তো। নায়িকা হওয়া হবে না। আমার পছন্দসই চরিত্রে অভিনয় করে সেরা কাজটাই দর্শকদের উপহার দেব।
‘পারমিতার একদিন’-এর পর অনেক দিন বাদে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের সঙ্গে ‘অলীক সুখ’ ছবিতে অভিনয় করছেন।
খুব ভাল লাগে। ঋতুপর্ণার সঙ্গে আমার কোনও দূরত্ব নেই। খুব ভাল বন্ধু ও। ‘পারমিতার একদিন’ যখন করছি তখন ঋতুর বয়স অল্প। আজকের মতো আইকন হয়ে ওঠেনি। সেই সময় থেকে বন্ধুত্ব। ফলে আমরা পরস্পরের কাছে খুব সহজ। অভিনয়ের কথা ছাড়াও ব্যক্তিগত অনেক কথা আলোচনা হয়।
‘অলীক সুখ’-এ আপনার চরিত্রটা কি ‘ইচ্ছে’র মতো গুরুত্বপূর্ণ?
‘ইচ্ছে’র মতো কি না বলতে পারব না। তবে গুরুত্ব তো আছেই। কারণ আমিই প্রধান পার্শ্বচরিত্র। এক জন ডাক্তারকে নিয়ে গল্প। সেখানে এক জন রোগিণীর চরিত্রে অভিনয় করছি। অন্য দুই চরিত্রে থাকছেন দেবশঙ্কর হালদার আর ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। প্লিজ আর জিজ্ঞেস করবেন না। |
|
ছবি: কৌশিক সরকার |
শুধু বাংলা সিনেমা নয়। বাংলা থিয়েটারেরও তরুণ মুখ আপনি। অন্য দিকে আপনার বাবা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর বয়স ৭৭। মা স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের বয়স ৬২। এই রকম একটা অবস্থায় ‘নান্দীকার’ নাটকের দলের প্রতি আপনার দায়িত্ব কতটা?
দায়িত্ব অনেকটাই। তার কারণ এইটা নয় যে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এবং স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর মেয়ে আমি। নাটককে প্রাণপণে ভালবাসি বলেই নান্দীকারকে ভালবাসি। না যদি ভালবাসতাম তবে কবেই কেটে যেতাম।
অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার আপনাদের দলের সেক্রেটারি হয়েও অন্য দলে অভিনয় করেন। এতে আপনাদের অসুবিধে হয় না।
হ্যাঁ। অসুবিধে তো হয়ই। তবে দেবুদা এত পেশাদার যে সময়মতো সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেন। দেবুদা যেখানে যত কাজই করুন না কেন নান্দীকারকে ফার্স্ট প্রায়োরিটি দেন।
এখন তো নান্দীকারের প্রেসিডেন্ট রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। এর পর কে পাবেন এই পদ?
জানি না। এ সব নিয়ে ভাবতেও চাই না। বাবার অবর্তমানে কী হবে সেটা ভাবতেও আতঙ্ক হয়। বাবা তো শুধু নান্দীকারের কথা ভাবেন না। পুরো থিয়েটার ফ্রেটারনিটির কথা ভাবেন। শুধু বাবা নন, মা-ও সে রকম মানুষ।
আপনি ইদানীং নান্দীকারের বাইরেও অন্য দলে অভিনয় করছেন। তা হলে কি এটা ধরে নিতে হয় নান্দীকারে কাজ করে আপনি পরিতৃপ্ত নন?
নান্দীকারে কাজ করে খুবই তৃপ্ত। ব্রাত্যদার পরিচালনায় ‘কন্যাদান’ নাটকে অভিনয় করেছি একটাই কারণে যে, ব্রাত্যদা আমাকে খুব ভালবাসেন। যাঁরা আমাকে ভালবাসেন, তাঁদের সঙ্গে দলের বাইরে গিয়েও কাজ করতে ভাল লাগে। ব্রাত্যদাকে আমি চিনি তেরো বছর বয়স থেকে।
অনেক দিন হয়ে গেল আপনি সিঙ্গল। এই ভাবেই কি জীবনটা কাটাবেন? নাকি কোনও সঙ্গী বেছে নেবেন ঠিক করেছেন?
প্ল্যান করে কিছু হয় না। তবে আমার বিয়ে করতে ভয় করে। সন্তান আনতেও ভয় করে।
এই আতঙ্কটা কেন?
আতঙ্ক আমার নিজেকে নিয়ে। আমি বড্ড বেশি ভাবি। মেয়েরা যে ভাবে যে-কোনও পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়, আমি সেটা পারি না। আমার মনে সব সময় প্রশ্ন তৈরি হয় কেন মানিয়ে নিতে হবে, ইচ্ছে না থাকলেও। আমার বাবা একেবারে অন্য রকমের মানুষ তো। যে ভাবে মা বাবার দাম্পত্যটা দেখেছি, তেমন খোলামেলা প্যাশনেট না হলে, তেমন বন্ধুত্ব তৈরি না হলে আমি বিয়ে করে সুখী হব না। এমনকী লিভ ইন করেও সুখী হব না। আমি যদি রাত দুটোর সময় শো করে ফিরি, আর আমার স্বামী যদি প্রশ্ন করে, “ কালকের সকালের রান্না কে করবে?’এরকম পরিস্থিতির সঙ্গে আমি খাপ খাওয়াতে পারব না। আমি বিবাহিত জীবনে স্বামী-স্ত্রীর সমান দায়িত্ববোধ চাই। বন্ধুত্ব চাই। |
আমি |
• বয়স: ৩৭ বছর
• পেশা: অভিনয়, শিক্ষকতা
• শখ: গান শোনা, কুকুর পোষা
• প্রিয় সিনেমা: পথের পাঁচালী
• প্রিয় নাটক: ‘নান্দীকার’-এর সব নাটক
• প্রিয় খাবার: খিচুড়ি
• আদর্শ: প্রত্যেক দিন নতুন করে বাঁচা
• লক্ষ্য: থিয়েটার করে যাওয়া জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত |
|
গৌতম হালদারের সঙ্গে বিয়েতে এটাই কি সমস্যা ছিল?
না। সমস্যা এটাই ছিল যে, তথাকথিত সংসার করার ছকে আমি সংসার করতে পারতাম না। পারিনি, আমিই পারিনি। গৌতম হালদারকে বিয়ে করে যেমন ছিলাম, তার চেয়ে একা আমি এখন অনেক ভাল আছি। আমি আর উনি মানুষ হিসেবে একেবারেই আলাদা রকম ছিলাম। আমাদের বেড়ে ওঠা আলাদা, জীবনদর্শনও আলাদা। তবে এই সব আলোচনা কেন। ইন্টারভিউয়ের সময় গৌতমদার সম্পর্কে এত আলোচনা এলে আমার প্রতি ফোকাসটা নষ্ট হয়ে যায় না কি?
এই যে একা জীবন আপনি কাটাচ্ছেন, এ নিয়েও তো নাটক হতে পারে? কত রকম অভিজ্ঞতা হয় একা থাকতে গেলে...
তা তো হয়ই। প্রচুর চড়াই উতরাই পেরোতে হয় বিয়ের পর আবার একা হয়ে গেলে। সেই সময় মনে হয় পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যে আমাকে ভালবাসতে পারে? আমাকে উদ্ধার করতে পারে? যে কোনও সম্পর্ককে খামচে ধরতে ইচ্ছে করে। একটা সাঙ্ঘাতিক হেল্পলেসনেস কাজ করে। পরে বুঝেছি নিজেকে উদ্ধার করতে হয় নিজেকেই। অন্য কেউ সেটা করে দিতে পারে না। প্রথম বিয়ে ভুল হলে, দ্বিতীয় বিয়ে দিয়ে সমস্যাটার সমাধান হয় না। খুব কষ্ট পেয়ে বাবাকে একদিন বলেছিলাম, বাবা, আমি কাকে বিশ্বাস করব? বাবা বলেছিল নিজেকে বিশ্বাস কর। আমি তার পর থেকে চেষ্টা করেছি যত ঝড়ঝাপটা আসুক নিজের কাজগুলো নিয়মিত করে যাওয়ার। তাই করেই নিজের প্রতি ভালবাসা, বিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। একা মেয়ের পথ চলা নিয়ে নাটক লেখা যায়ই। দেখি কবে লিখে উঠতে পারি।
আপনি যে এত বাছাই করে কাজ করেন, তাতে সংসার চলবে তো? সেভিংস হবে কী করে? একা মেয়ের তো সেভিংস লাগে।
আমি যে স্কুলে পড়াই সেখান থেকে বেশ খানিকটা টাকা আসে। নাটকের দল থেকে কিছু মাসমাইনে পাই। আর যদি কোনও বিপদআপদ হয় তা হলে থিয়েটার শিল্পীরা আমাকে দেখবেন এটা আমি বিশ্বাস করি। অনেক টাকা রোজগার করে গ্ল্যামারাস জীবন আমি চাই না। তাতে সাধারণ জীবনে বাঁচার মজাটা চলে যাবে।
আপনি তরুণ নাট্যপ্রতিভা। আজকের নতুন প্রজন্মকে নিয়ে নাটক পরিচালনা করছেন না কেন?
আমি যে সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, সেই সময় নিয়ে নাটক করব না। আমি তেমন নাটকই করব যার রেশ অনেক দিন থাকবে। তাই ‘বেলাশেষ’-এর মতো নাটক বেছেছি যেখানে এক বৃদ্ধ দম্পতির প্রেমের গল্প রয়েছে। নাটকটার প্রথম শো ভ্যালেনটাইন্স ডে’র দিন। রাজনীতি নিয়ে নাটক করে সমাজ পাল্টানো যায় না, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
২০১৩তে কী কী কাজ করছেন?
‘বেলাশেষ’ পরিচালনা। ‘অলীক সুখ’-এ অভিনয়। ‘স্ত্রীরপত্র’ নাটক পরিচালনা করছি। অর্পিতা ঘোষ ‘মৃণালিনী’-র চরিত্রে অভিনয় করছেন। আর ‘নান্দীকার’-এর ‘নাচনী’ নাটকে অভিনয় করব।
আপনি বিয়েতে আর বিশ্বাসী নন? সন্তানেও বিশ্বাসী নন? সন্তান তো জীবনে একটা আনন্দ আনে........
হ্যাঁ, কারও কারও ক্ষেত্রে সেটা আনে। তবে আমি এই সম্পর্কের তথাকথিত বন্ধন মানি না। স্বামী-স্ত্রী- সন্তানের চেনা ছকের বাইরে জগৎটাকে ভাবতে চাই। আমি দেখেছি শুধু ভালবাসা দিয়ে অন্যের সন্তানকে নিজের বানানো যায়। আমি রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের নিজের মেয়ে নই। তা সত্ত্বেও আমাদের মতো পিতা-পুত্রী বিরল। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তকে বাবা হিসেবে না পেলে আজকের সোহিনী তৈরি হত কিনা সন্দেহ। যদিও আমার মাকে আমি দারুণ ভালবাসি। মাও আমাকে খুব ভালবাসেন। অত্যন্ত সাহসী মহিলা হিসেবে তিনি আমার জীবনের আদর্শ। |
|
|
|
|
|