যাঁর জমি, তিনিই জানেন না। অথচ কিছু সরকারি অসাধু কর্মীর বদান্যতায় তাঁর নামেই দিব্যি তৈরি হয়ে যাচ্ছে কাগজপত্র। চুপিসাড়ে বেহাত হয়ে যাচ্ছে বিঘার পর বিঘা জমি।
হুগলির ডানকুনি, চণ্ডীতলা থেকে শ্রীরামপুর মূলত দিল্লি রোড লাগোয়া কৃষিজমি চলে যাচ্ছে জমি-হাঙরদের গ্রাসে। পিছনে এমন চক্র সক্রিয়, যারা নকল কাগজপত্র তৈরি করে জমি হাতাতে সিদ্ধহস্ত। ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের (বিএলএলআরও) লোকজনও এতে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। মূল পাণ্ডা হিসেবে উঠে এসেছে এক মহিলার নাম। তিনি অবশ্য এখনও অধরা। এলাকায় একটু কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে তাঁর কীর্তিকাহিনি।
যেমন, ডানকুনির মোল্লাবেড়েতে ৩ একর ৬০ শতক জমি ছিল স্থানীয় বাসিন্দা অশোক সরকারের নামে। ১৯৯৫ সাল থেকে তিনি নিখোঁজ। বাড়িতে স্ত্রী ও দাদা-বৌদিরা থাকেন। কয়েক মাস আগে তাঁরা মনস্থ করেন, কিছু জমি বিক্রি করবেন। কিন্তু সরকারি দফতরে খোঁজখবর করতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ! শোনেন, বেমালুম বেহাত হয়ে গিয়েছে জমি। ডানকুনি থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন অশোকবাবুর দাদা অনিল সরকার।
তদন্তে নেমে চোখ কপালে ওঠে পুলিশ অফিসারদেরও। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, এক ব্যক্তি অশোক সরকার সেজে জমিটি বিক্রি করে দিয়েছেন। তাঁকে শনাক্ত করেছেন সঞ্জয় বিশ্বাস নামে এক জন। সেই জমি দিব্যি ‘মেসার্স প্রথম ডিল মার্ক প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থার নামে রেজিস্ট্রি হয়ে গিয়েছে। কিনেছেন জনৈক মহিলা। বছর চল্লিশের ওই মহিলার বেহালা-সহ নানা একাধিক জায়গায় বাড়ি আছে বলেও তদন্তকারীরা জেনেছেন।
চণ্ডীতলার নৈটির বাসিন্দা সুশান্ত কোলে নিজে তিন বার নৈটি পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ছিলেন। এখনকার তৃণমূল পরিচালিত বোর্ডের প্রধানও ছিলেন তিনি। ২০১১ সালের অক্টোবরে দলেরই কিছু সদস্যের আনা অনাস্থা প্রস্তাবে গদিচ্যুত হন। এ হেন প্রভাবশালী লোকের জমিও কিন্তু রক্ষা পায়নি। সুশান্তবাবুর বাবার নামে ডানকুনির মোল্লাবেড় মৌজায় ৭০ শতক এবং ১.২৮ শতকের দু’টি জমি আছে। তাতে চাষ হয়। অভিযোগ, ৭০ শতক জমিটি ডানকুনি, নৈটি, গোবরা, চিকরণ্ড জলাপাড়ার কিছু দালালকে কাজে লাগিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়। সুশান্তবাবুর কথায়, “দুষ্টচক্রের কেউ এক জন আমার বাবা সেজে গিয়েছিল। একটি ক্ষেত্রে সে মুকুন্দ বাগ নামে গোবরার এক জনকে জমি বিক্রির এক্তিয়ার (পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি) দিয়েছে। মুকুন্দ আবার সেই জমি বিক্রি করেছেন অন্য এক জনকে। অপর ক্ষেত্রে, বাবা সরাসরিই জমি বিক্রি করেছেন। সঞ্জয় বাগ নামে এক জন বাবাকে শনাক্ত করেছেন। অথচ বাবা মারা গিয়েছেন ৩৫ বছর আগে।”
এ ক্ষেত্রেও ক্রেতা সেই একই মহিলা, তার সঙ্গে আর এক জন ব্যক্তি। সুশান্তবাবু বলেন, “আমরা আদালতে মামলা করলে পুলিশ মুকুন্দ বাগ এবং সঞ্জয় বাগ নামে দুই যুবককে গ্রেফতার করে। বাকিরা পলাতক বলে জানায়।” তাঁর অভিযোগ, “সরকারি অফিসাররা জড়িত না থাকলে অনায়াসে কাগজপত্র জাল করা সম্ভব নয়।” তদন্তকারীদের ধারণা, চক্রটি কলকাতা থেকে নিয়ন্ত্রিত। কলকাতায় ওই মধ্যবয়সী মহিলার অফিসেই চলে যাবতীয় কারসাজি। তবে পরিচয়টি সঠিক কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। চোরাগোপ্তা বিকিয়ে যাওয়া জমির পরিমান ঠিক কত, তা-ও ভেবে পাচ্ছেন না তদন্তকারী অফিসারেরা।
এক পুলিশকর্তার কথায়, “আমরা কয়েকটি ঘটনার কথা জেনেছি মাত্র। কিন্তু যে ভাবে চোরাগোপ্তা কাগজপত্র তৈরি হয়েছে, তাতে এটাকে হিমশৈলের চূড়া বলে মনে হচ্ছে।” ইতিমধ্যেই একাধিক থানায় অভিযোগ জমা পড়েছে। চক্রের একাধিক পাণ্ডা ধরাও পড়েছে পুলিশের হাতে। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “জমি রেজিস্ট্রি করানো বেশ সোজা। সে ক্ষেত্রে খুব একটা খোঁজখবর নেওয়া হয় না। অসঙ্গতি ধরা পড়লে মিউটেশন আটকে দেওয়া যায় মাত্র।” তাঁর মতে, আইনের ফাঁক গলেই একের পর এক জমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। তা আটকাতে রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত আইনের বদল দরকার।
ভুয়ো কাগজপত্র দাখিল করে অন্যের জমি বিক্রির অভিযোগে গত জুলাইয়ে দু’জনকে গ্রেফতার করেছিল শ্রীরামপুর থানার পুলিশ। শ্রীরামপুরের পেয়ারাপুরে ওই জমির মালিক চায়না ভুঁইঞা সল্টলেকে থাকেন। পেয়ারাপুরে তাঁর ৯০ শতক জমি ছিল। পুলিশে দায়ের করা অভিযোগে তিনি জানান, নীলকান্ত মণ্ডল, হেমন্ত মণ্ডল, তাপস সেন, অসিত দাস, শিবু মেটে-সহ এলাকার কয়েক জন বাসিন্দা তাঁকে জমিটি বিক্রি করার অনুরোধ করেছিলেন। তিনি রাজি হননি। পরে জানতে পারেন, জাল নথিতে তাঁর জমি বেহাত হয়ে গিয়েছে। সরকারি দফতরে কাগজপত্র ঘেঁটে দেখেন, তিনি নিজেই নাকি তাপস বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তিকে জমি বিক্রির এক্তিয়ার (পাওয়ার অফ অ্যার্টর্নি) দিয়েছিলেন। অভিযোগ পেয়ে অসিত ও নীলকান্ত নামে শেওড়াফুলির জগদ্ধাত্রীপাড়ার দুই যুবককে পুলিশ গ্রেফতার করে। বাকিরা গা-ঢাকা দেয়।
পুলিশের দাবি, সরকারি কিছু লোকের যোগসাজসেই অবৈধ উপায়ে জমি বিক্রির ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে বলে ধৃতেরা জেরায় জানিয়েছে। হুগলির পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, “প্রত্যেকটি অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। কয়েক জন গ্রেফতারও হয়েছে। কোনও সরকারি অফিসারের বিরুদ্ধেও যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” পুলিশের তরফে শ্রীরামপুরের মহকুমাশাসক জয়সি দাশগুপ্তকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, “অনেক মানুষের কাছেও অভিযোগ পেয়েছি। ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের ভূমিকা নিয়ে বিভাগীয় স্তরে তদন্ত হচ্ছে। তাঁর আশ্বাস, “কেউ দোষী প্রমাণিত হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড়ার প্রশ্ন নেই।”
রাঘব-বোয়ালেরা যখন গভীর জলে ঘুরছে, শুধু চুনোপুঁটি ধরে যে লাভ হবে না তা অবশ্য কর্তারা ভালই জানেন। |