|
|
|
|
ও তখন রক্তে ভাসছে, আর তর্কে ব্যস্ত পুলিশ
নিজস্ব প্রতিবেদন |
ঘটনার দু’দিন পর থেকেই প্রতিবাদে মুখর হতে শুরু করেছিল গোটা শহরটা। ধীরে ধীরে তাদের গর্জনে শুধু রাজধানী দিল্লি নয়, কেঁপে উঠেছিল গোটা দেশ। কিন্তু মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে ওই শহরটাই কী অসীম উদাসীনতায় চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল রাস্তার ধারে পড়ে থাকা রক্তাক্ত, নগ্ন দুই তরুণ-তরুণীর দিক থেকে! এমনকী সামনে এসে দাঁড়িয়েও সাহায্যের বদলে আলোচনা করেই অনেকটা সময় কাটিয়ে দিয়েছিল দিল্লি পুলিশের তিন-তিনটি টহলদারি গাড়িও!
টিভি স্টুডিওতে বসে কথাগুলো বলতে বলতে মাঝেমধ্যেই যেন কেঁপে উঠছিলেন যুবকটি। শুক্রবারই প্রথম টিভি চ্যানেলের সামনে মুখ খুললেন ২৮ বছরের তরুণ। দিল্লির তরুণীর গণধর্ষণের একমাত্র সাক্ষী। সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে সম্ভবত চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল ১৬ ডিসেম্বরের রাত্রির সেই কয়েক ঘণ্টা। যার আঘাত সামলাতে না পেরে গত সপ্তাহেই সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে মৃত্যু হয়েছে ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর।
সে দিনের ঘটনার পরে নিজেও দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পরে অপেক্ষা করেছিলেন বান্ধবীর সুস্থ হয়ে ওঠার। কিন্তু তা আর হল কই? তাই অপরাধীদের শাস্তির জন্য সাক্ষ্য দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছেন।
ঠিক কী হয়েছিল সে দিন? সংবাদমাধ্যমে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যা প্রকাশিত হয়েছে, তার বাইরেও অনেক কিছু রয়েছে বলে দাবি করলেন ওই তরুণ। তাঁর বক্তব্য, সে দিনের ঘটনায় রীতিমতো ছক কষে এগিয়েছিল অভিযুক্তরা। একটি বাসে চালক ও খালাসি ছাড়া বাকিরা যাত্রী সেজে বসেছিল। বাসে উঠে ২০ টাকা ভাড়াও দিয়েছিলেন তাঁরা। বাসে ওঠার কিছু ক্ষণ পরেই তাঁর বান্ধবীকে উত্যক্ত করতে শুরু করে অভিযুক্তরা। শুরু হয় গোলমাল। তিন জনকে মেরেওছিলেন তিনি। কেউ লোহার রড দিয়ে তাঁকে মারে। অজ্ঞান হয়ে যান তিনি। তাঁর বান্ধবী নিজেকে বাঁচাতে প্রাণপণ লড়াই করেছিলেন। ধ্বস্তাধ্বস্তির সময় সাহায্য চেয়ে চিৎকারও করেন তাঁরা। তখনই বাসের আলো নিভিয়ে দেয় অভিযুক্তরা। তাঁর বান্ধবী পুলিশের নম্বর ডায়াল করার চেষ্টা করলে ছিনিয়ে নেওয়া হয় মোবাইল। অজ্ঞান হয়ে পড়ার পরে যুবকের কাছ থেকে তাঁর বান্ধবীকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় অভিযুক্তরা। |
তিনটি পুলিশ ভ্যান এল,
কিন্তু কেউ আমাদের সাহায্য করল না।
দামিনীর সেই বন্ধু |
|
প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে বাসটি নিয়ে দিল্লির রাজপথে ঘুরেছিল অভিযুক্তরা। ততক্ষণে জ্ঞান এসেছে ওই তরুণের। কিন্তু জানতেও পারেননি বান্ধবীর উপরে কী অকথ্য অত্যাচার হয়েছে। অভিযুক্তেরা তাঁদের কাছে থাকা সবকিছু কেড়ে নিয়ে প্রমাণ নষ্টের জন্য জামাকাপড়ও ছিঁড়ে দিয়ে দু’জনকে চলন্ত বাস থেকে বাইরে ঠেলে ফেলে দেয়। তাঁদের চাপা দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়। কোনও রকমে বান্ধবীকে টেনে সরিয়ে আনতে পেরেছিলেন যুবক।
এর পরেও বাকি ছিল অনেক কিছু। এ দিন ওই তরুণের কথায়, “আমরা রাস্তা দিয়ে যাওয়া লোকজনকে ডেকে থামানোর চেষ্টা করি। কয়েকটা অটো-গাড়ি-বাইক গতি কমালেও থামেনি। প্রায় ২৫ মিনিট পরে কেউ একজন পুলিশকে খবর দেয়।” পুলিশ এসে পৌঁছয় আরও ৪৫ মিনিট পরে। একটি নয়, তিন-তিনটি পুলিশের গাড়ি এসে পৌঁছয়। বান্ধবী তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া বা পোশাকের ব্যবস্থা করার বদলে ঘটনাটি কোন থানা এলাকায় পড়ে, তা নিয়ে তর্ক শুরু করে পুলিশ! তাঁর কথায়, “তিনটি পুলিশ ভ্যান এল, কিন্তু ওরা কেউ আমাদের সাহায্য করল না!” অনেক অনুনয়ের পরে তাঁর বান্ধবীর দেহ ঢাকতে একটি বিছানার চাদর দিয়েছিল কেউ! ততক্ষণ? “ওরা শুধু আমাদের দেখছিল!” বান্ধবীকে নিজেই বয়ে গাড়িতে তোলেন তিনি। পুলিশ বা ততক্ষণে ভিড় করা জনতা সাহায্যও করেননি। কাছের হাসপাতালে নয়, চিকিৎসার জন্য তাঁদের অনেক দূরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানেও অনেক অনুনয়ের পরে পোশাকের ব্যবস্থা হয়। ফোন করে নিজের আত্মীয়দের খবর দেন যুবক। আত্মীয়রা আসার পরেই তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়।
বান্ধবীর সঙ্গে অভিযুক্তরা ঠিক কী আচরণ করেছিল, তা অনেক পরে জানতে পারেন যুবক। সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটকে দেওয়া বান্ধবীর বয়ান শুনে তাঁর মনে হয়েছিল, “পশুরা শিকারে বেরিয়েও এমন আচরণ করে না।” সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযোগ ছিল, জবানবন্দি নেওয়ার সময়ে দিল্লি পুলিশ তাঁকে চাপ দিয়েছিল। যুবকের মন্তব্য, “এটা পুরোপুরি বাজে কথা।” তাঁর আক্ষেপ, ওই যন্ত্রণার মধ্যেও অনেক কষ্ট করে তাঁর বান্ধবী জবানবন্দি দিয়েছিলেন। বিতর্কের জেরে সেই জবানবন্দির আর কোনও মূল্যই থাকেনি।
কখনও বান্ধবীর পাশ থেকে সরে যাওয়ার কথা ভাবেননি যুবক। জানিয়েছেন, হাসপাতালে শুয়েও তাঁর বান্ধবী কখনও মনোবল হারাননি। বাঁচতে চেয়েছিলেন। পারেননি।
আর তিনি? বেঁচে গিয়েছেন। যন্ত্রণা আর কষ্টকে ছাপিয়ে যায় একটা বড় আক্ষেপ, “কেন সে দিন অটোয় চড়লাম না, ওই বাসটাতে উঠলাম!” |
|
|
|
|
|