প্রবন্ধ ১...
আলোড়ন এক দিন স্তিমিত হবে, তার পর?
রাজধানী দিল্লিতে একটি মেয়ের মৃত্যুতে দেশ যখন উদ্বেল, তখন বারাসতে একটা ঘটনা ঘটে। ইটভাটায় কর্মরত এক মহিলা বাড়ি ফেরার পথে দুষ্কৃতীদের হাতে নিহত হন। তাঁর পুরুষ সঙ্গী (এ ক্ষেত্রে স্বামী) অ্যাসিডে ঝাঁঝরা হয়ে সঙ্কটজনক অবস্থায়।
মহিলা ধর্ষিতা, এমনকী গণধর্ষিতা হয়েছিলেন কি না, এখনও নাকি স্পষ্ট নয়। চিকিৎসক দল ও তদন্তকারী পুলিশ আরও তথ্যের অপেক্ষায় আছেন। তাঁরা মিথ্যাচার করছেন এমন প্রমাণ নেই, তবু জনমানসে সন্দেহের শিকার হয়েছেন। নানা দুর্ভাগ্যজনক উক্তি ও পূর্বেকার ঘটনা নিয়ে টালবাহানার ফলে শাসকগোষ্ঠীর বিশ্বাসযোগ্যতা এমন তলানিতে ঠেকেছে, শেষ অবধি ধর্ষণের অভিযোগ তথ্যপ্রমাণসহ নাকচ হলেও বহু লোকে সন্দিগ্ধ থেকেই যাবে। বারাসতের পুলিশ কর্তা বিশেষ করেই দিল্লির ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেছেন। তাঁর সদিচ্ছা প্রমাণের সুযোগ বড় মর্মান্তিক ভাবে হাতে এসে গেল।
আপাতত প্রশ্ন কিন্তু কর্তৃপক্ষ নয়, সহনাগরিকদের কাছে। ধর্ষণের বিষয়টা অমীমাংসিত থাকলেও দিল্লির সঙ্গে বারাসতের ঘটনার বহু উদ্বেগজনক মিল। তফাত শুধু এই, দিল্লির তরুণীর মৃত্যু হল তেরো দিন বাদে, বারাসতের মহিলার সঙ্গে সঙ্গে। সমাপতন সত্ত্বেও ঘটনাটা তেমন প্রতীকী গুরুত্ব পায়নি, মিলটা যেন মানুষের চোখে ঠেকেনি। কলকাতার সর্বপ্রচারিত ইংরেজি দৈনিকে খবরটা লুকিয়ে ছিল ভিতরের পাতায়; জাতীয় এমনকী স্থানীয় চ্যানেলে সম্প্রচার হয়েছে নিচু পর্দায়। এই মহিলার আত্মীয়বন্ধুরা ফেসবুক করেন না। তরুণসমাজের যে অংশ করেন, তাঁদের মধ্যে এ নিয়ে সংযোগ ঘটেছে জানা গেল, দেখা যাক বার্তা কত দূর ছড়ায়।
তাই বিচলিত প্রশ্ন: মুখে যা-ই বলি, দিল্লির সেই শোচনীয় ঘটনা সত্যিই আমাদের জীবন ছুঁয়েছে কি? বারাসতের অধিবাসীরা সরব, তাঁদের উদ্বেগ বাংলার আর সকলে আত্মস্থ করেছি কি? তামাম দেশের মতো এ রাজ্যেও দিল্লি নিয়ে প্রচুর সভা-অনুষ্ঠান হচ্ছে, মোমবাতি-মিছিল হচ্ছে। নাগরিক হিসাবে ভরসা পাব যদি বঙ্গবাসীর শোক ও ধিক্কারে বড় করে ফুটে ওঠে আমাদের দোরগড়ায় ঘটা, ভারতব্যাপী অনাচারের স্থানীয় দৃষ্টান্তগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিচারের দাবি। নইলে বলতেই হবে, দিল্লির মেয়েটির জীবনবলির সক্রিয় স্মৃতিরক্ষায় আমরা অপারগ, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় উত্তেজনার আগুন পোহাচ্ছি মাত্র।
মনে রাখতে, লেগে থাকতে পারব? কলেজ স্কোয়ার, কলকাতা, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১২। ছবি: সুদীপ আচার্য
পাঠককে দোহাই, এ কথা প্রাদেশিকতা থেকে বলছি না। আমি পুরুষ, উপরন্তু সমাজের অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত স্তরের বাসিন্দা; তেমন অধিকাংশ বাসিন্দার মতো সামাজিক ভাবে বলহীন, নানা পাপের মতো নারীনির্যাতনের প্রতিটি নৃশংস ঘটনার বিহ্বল অসহায় দর্শকমাত্র। তবু নারীপুরুষ নির্বিশেষে বিন্দুমাত্র সততাসম্পন্ন কোনও দর্শক এমন ঘটনায় যে বেদনা বোধ করেন, তাতে আমাদের অভ্যস্ত ক্ষুদ্রতা ছাপিয়ে মৌলিক মানবতার একটু যেন ছোঁয়া লাগে। আমি তাই প্রবল ভাবে আশ্বস্ত হতে চাই, আজ চার দিকে এত ধিক্কার, এত ধর্মকথা, সমাজ পাল্টাবার এত অঙ্গীকার, এগুলি কেবল উচ্ছ্বাসের বুদবুদ নয়, কোথাও একটু মাটি আছে, যাতে এক-আধটা অঙ্কুর পাতা মেলতে পারে। দিল্লির তরুণীর মতো, ভারত জুড়ে অসংখ্য নারী বীভৎস আক্রমণ, এমনকী মৃত্যু বরণ করে আমাদের সেই আশ্বাস জোগাবার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যাচ্ছেন।
প্রত্যেক রাজ্যের বাসিন্দার উপর তাই দায় বর্তাচ্ছে, দিল্লির ঘটনা মাথায় রেখে তাঁদের গ্রামে-শহরে অনুরূপ ঘটনা নিয়ে সরব হওয়ার। নইলে সুদূর দিল্লি নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় আজ বাদে কাল হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে, সেফটি ভালভ দিয়ে নির্গত বাষ্পের মতো। যে নিষ্ক্রিয় স্বার্থমগ্ন প্রশাসন, রাজনীতির উত্তরোত্তর নির্লজ্জ প্রশ্রয়ে সমাজের যে দুর্বৃত্তায়ন এই প্রতিবাদের আসল লক্ষ্য, তার কুশীলবেরা আবার সদর্পে আস্ফালন করে বেড়াবে— যদি আদৌ সে আস্ফালনে কোনও ভাটা পড়ে থাকে।
আশ্বস্ত হওয়ার জন্য অবশ্য আরও কিছু দরকার। নারী-উৎপীড়নসহ নানা অপরাধের ঘাঁটি হিসাবে বারাসত বদনাম কিনেছে। ওই অঞ্চলের জনপ্রতিনিধিরা এ সব নিয়ে একাধিক বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। তাই বিশেষ করে প্রশ্ন, সেখানকার কোন মামলার কত দূর কিনারা হল? অন্যত্রই বা কী? পার্ক স্ট্রিট তদন্তে এখনও চার্জশিট পেশ হয়নি আমরা জানি। জানি না কাটোয়ার ধর্ষণ-মামলা বা মালদায় ধর্ষণ-সহ খুনের মামলার পরিস্থিতি, মালদার চোদ্দো বছরের ধর্ষিতা কিশোরীর বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা। জানি না হাওড়ার সেই ধর্ষিতা মহিলার হাল, বলাৎকারের পর রক্তাক্ত অবস্থায় থানায় গেলে বড়বাবু যাঁকে চৌকাঠ থেকে ভাগিয়ে দেন।
যেন মনে পড়ে, সেই অফিসারকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। তার পর? কয়েক মাস কেটে গিয়েছে: ধর্ষণের তদন্ত তো বটেই, সেই অফিসারের আচরণের কী তদন্ত হল? এখানে সংবাদমাধ্যমের একটা ভূমিকা আছে। তাঁদের কাছে নিবেদন, নতুন অনাচারের চাঞ্চল্যকর বিবৃতি থেকে কিছু বাইট, কিছু কলম-ইঞ্চি ধার নিয়ে নিয়মিত কিছু বাসি খবর পরিবেশন করুন: ছ’মাস বা এক বছর আগের কোনও শিউরে-তোলা অপরাধের তদন্ত কী পর্যায়ে, কোনটা ধামাচাপা পড়েছে বা সরকারি অপরাধীরা পুরস্কৃত হয়েছে। জনমানসের বিস্মৃতি পাপের মস্ত হাতিয়ার। বত্রিশ বছর আগে ভাগলপুরে হাজতবাসীদের চোখ বিঁধিয়ে দেওয়ায় দেশ তোলপাড় হয়েছিল, আজ কারও মনে আছে? পুলিশি নির্যাতন বিন্দুমাত্র হ্রাস পেয়েছে? দিল্লির ধর্ষণকাণ্ডে ভারত জুড়ে অরাজনৈতিক নাগরিক সমাজ বিশাল প্রতিবাদে নেমেছে, ভাল কথা। কিন্তু তার পর?
অল্প লোকই সামাজিক আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করে; যারা করে, প্রায় সকলেই তলিয়ে যায় রাজনীতির আবর্তে। যে ঝকঝকে তরুণী ও তরুণেরা আজ মহৎ আবেগে ইন্ডিয়া গেটে বা দেশের অন্যত্র ভিড় জমাচ্ছে, হয়তো তাদের হাজারে এক জন রাজনীতিক বা সমাজসেবী হবে, তার মধ্যেও হাজারে এক জন বলার মতো কিছু করবে। বাকিরা ফিরে যাবে লেখাপড়ায়, কাজকর্মে, সাংসারিক জীবনে। এটা শুধু অবধারিত নয়, স্বাভাবিক ও কাম্য। শেষ অবধি দেশ শাসনের দায় বর্তাবে পূর্ণসময়ের রাজনীতিক ও প্রশাসকদের উপর। বাকিদের কি পুনর্মূষিক না হয়ে গতি নেই?
প্রতিবাদীদের বড় অংশ যে মধ্যবিত্ত সৌভাগ্যবান স্তরের, সেটা যেমন এই আন্দোলনের দুর্বলতা, তেমনই এক দিকে তার শক্তিও বটে, কারণ শিক্ষিত সরব শ্রেণিই শাসকগোষ্ঠীর উপর তবু কিছু চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তার একটা উপায় অবশ্যই ভোটদান, যাতে অন্যান্য শ্রেণির অবদান সমান বা বেশি হতে পারে। অন্যান্য পন্থা সংবাদমাধ্যমের ব্যবহার, সেগুলির নিজস্ব নানা অভিসন্ধি ও বিচ্যুতি সত্ত্বেও; মানবাধিকার, তথ্যের অধিকার প্রভৃতি কিছু রাষ্ট্রীয় নীতির প্রয়োগ, যা চরম অস্বস্তি সত্ত্বেও শাসকগোষ্ঠী চালু করতে বাধ্য হয়েছে; শেষ অবলম্বন হিসাবে, ধৈর্য ও অর্থবল থাকলে একা না পারলেও সম্মিলিত ভাবে আদালতের শরণ। আমাদের দেশে ন্যায়বিচারের রাস্তা কণ্টকিত, দীর্ঘসূত্রী ও ব্যয়বহুল; তবু উচ্চ আদালতের কিছু অসামান্য বিচারে জনজীবনের প্রভূত উপকার হয়েছে, এবং আর সব কর্তৃপক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখালেও আদালতের আদেশ এখনও কিছুটা মান্য করতে হয়।
এই হাতিয়ারগুলি আছে বলেই অরাজনৈতিক নাগরিক সমাজের প্রতি রাজনৈতিক শাসকগোষ্ঠী ও তাদের অনুগত প্রশাসককুল এত বিরূপ, অরাজনৈতিক আন্দোলনের রাজনীতিকরণের এত চেষ্টা (যেমন দিল্লিতে এখন চলছে বলে অভিযোগ)। কিন্তু এই চেষ্টাও যেন অবান্তর, কারণ আমরা এমনিতেই সমাজের দায় রাজনীতিকদের হাতে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত। যতই শাপশাপান্ত করি, তাঁদের দ্বারা চালিত হওয়া, তাঁদের জিগির মেনে নেওয়া যেন আমাদের ভবিতব্য, অন্য রকম আমরা ভাবতেই পারি না।
এর মারাত্মক ফল, সমাজের বৃহত্তর রীতিনীতি মূল্যবোধ বিপর্যস্ত হচ্ছে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রভাবে। রাজনীতিক বা তাঁদের আশ্রিতদের বচন যতই তরল, ভ্রান্ত বা অন্যায় হোক, পদার্থবিচারে যতই আলোচনার অযোগ্য হোক, তাকে গুরুত্ব দিতে হয়, কারণ তার দ্বারাই জনজীবন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ধর্ষণ, নারী-নির্যাতন ও নারীর সম্মান নিয়ে যে বঙ্গসন্তানদের উক্তি সম্প্রতি সারা ভারতে চর্চিত হচ্ছে, তাঁরা রাজ্যের বিভিন্ন মুখ্য দলের সদস্য। বঙ্গবাসীর পক্ষে এটা গৌরবের কথা নয়।
রাজ্যে সাম্প্রতিক ধর্ষণের ঘটনাগুলির কোনও রাজনৈতিক ইতিহাস আছে, এমন ধারণা জনমানসে নেই। আক্রান্ত মহিলারা ব্যক্তিপরিচয় ও সামাজিক অবস্থানের বিচারে সম্পূর্ণ ভিন্ন, যদিও প্রায়ই দরিদ্র শ্রমজীবী; যত দূর জানা যায়, কারও কোনও রাজনৈতিক রং নেই। (থাকলেই বা কী?) আদতে ‘অরাজনৈতিক’ এই মামলাগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি করলে, ও সেই সঙ্গে নির্যাতিতাদের পাশে দাঁড়ালে, সরকার তথা শাসকদলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হত বলেই আমরা ভাবতে পারি। তার বদলে কোনও অজ্ঞাত কারণে তাঁরা ঘটনাগুলি দেখছেন শুধুমাত্র তাঁদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আঘাত হিসাবে, অতএব সেগুলি নস্যাৎ করছেন ও আক্রান্তদের গঞ্জনা দিচ্ছেন। তা-ও করছেন যে দোহাই পেড়ে, তাতে নারীবিশেষ বা ঘটনাবিশেষ ছাপিয়ে সমাজে নারীর স্থান ও সম্মান নিয়ে সাধারণ ভাবে কিছু মারাত্মক বার্তা ফুটে উঠছে। এ সব উক্তি আদৃত হবে সমাজের সবচেয়ে অন্ধ প্রতিক্রিয়াশীল অংশে, যেখানে নীতি-যুক্তি বিসর্জন দিয়ে অন্ধ প্রাগৈতিহাসিক বিকর্ষণে ‘নষ্ট হয়ে যাওয়া’ নারীকে একঘরে করা বা বিতাড়িত করা আজও প্রচলিত। আমাদের শাসককুল সজ্ঞানে এমন বিকার চরিতার্থ করছেন এটা নিশ্চয়ই আমরা মানব না, বিশেষ করে তাঁদের মুখপাত্রদের অনেকে যখন শিক্ষিত, সপ্রতিভ, স্বক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত মহিলা। কিন্তু সেই অশুভ শক্তিগুলি এর ফলে কার্যত কতটা প্রশ্রয় পাচ্ছে, তা না ভাবলেই নয়। দিল্লির ঘটনা নিয়ে প্রকাশ্য আলোড়ন এক দিন না এক দিন স্তিমিত হবে। তার পর?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.