|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
ইস্পাতের যোনি নিয়ে জন্মাব এ বার |
‘নিপীড়ন সইতে না পেরে নিজের জীবন নেব না আমি। লড়ব। থানা যদি অভিযোগ না নেয়,
মহল্লা আর গ্রামের লোক এনে ঘিরে ফেলব থানা। যে পার্টি হিংসার দায়ে দোষীদের দাঁড় করায়, তাদের
বয়কট করব। ত্যাগ করব তাদের, যারা নারীর প্রতি হিংসাকে আচরণে ভাষায় লেখায় সমর্থন করে।’
অনিতা অগ্নিহোত্রী |
তোমরা আমার নাম জানো না, মুখখানাও দেখনি। অথচ আমার জন্য হাজারে হাজারে এসেছিল যন্তরমন্তর, বিজয় চক আর ইন্ডিয়া গেট-এ। শীতের মধ্যে লাঠি, জলকামান সব সয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলে। ওরই মধ্যে একদল ইটপাথর মেরে, গাড়ি-বাস জ্বালিয়ে তুমুল হল্লা করছিল। তাদের অনেকে তোমাদের সঙ্গেও অসভ্যতা করেছে। মেয়েরা অনেকেই সে কথা বাড়িতে জানাওনি। এত যন্ত্রণার মধ্যে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা কষ্টের মধ্যেও তোমাদের এই আসা, ছেলে আর মেয়েদের পাশাপাশি দাঁড়ানো আমার ভাল লেগেছে। কিন্তু মনটা যেন কেমন বেঁকে-তুবড়ে গেছে আমার; যদি বাসে, ট্রেনে, মেট্রোয়, রাস্তায় মেয়েদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার হয়, এই ছেলেরা প্রতিবাদে ঘুরে দাঁড়াবে তো?
কেউ কেউ মুখ খুলবে না, কারণ এ দেশের পুলিশ অভিযোগকারিণী আর তার সাক্ষীদের যথেষ্ট নাস্তানাবুদ করে। অনেকে কিছু বলবে না, কারণ কোনও মাথা উঁচু করে হাঁটা শিক্ষিত মেয়ের যদি এ ভাবে পথে না বেরনোর শাস্তি হয় তবে হোক না। আচ্ছা, তোমরা ক’জন মা’কে চেনো, যারা ছেলেকে ছোটবেলা থেকে শেখায় বাড়ির কাজে হাত বাড়াতে, মেয়েদের সমান বলে ভাবতে, তাদের ওপর হিংসাকে মেনে না নিতে... না, না, তোমাদের এই জমায়েতকে আমি ছোট করে দেখছি না, কিন্তু মেয়েদের জন্য দুনিয়া বদলানোর কাজ বোধ হয় ক’দিনের ধরনা আর জমায়েতে হবে না।
যতই দেখছি, নিশ্বাসটা কেমন বন্ধ হয়ে আসছে। কাগজে কাগজে প্রবন্ধের বন্যা, টেলিভিশনে আসতে কারও বাকি নেই। নারী সংগঠন, প্রাক্তন বিচারপতি, পুলিশ, প্রাক্তন পুলিশ, রাজনৈতিক দল। কেউ চাইছে ধর্ষকের ফাঁসি, কেউ চাইছে কড়া আইন, কিন্তু মেয়েটাকে থানা পর্যন্ত কে পৌঁছে দেবে, এটা কেউ বলছে না। আমি যখন আই সি ইউ-তে, তখনই তো আত্মহত্যা করল পঞ্জাবের আক্রান্ত মেয়েটা। ধর্ষণ, তার পর পুলিশের যৌন হয়রানি। দিল্লির কালকাজিতে ধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে দিল আর এক জনকে। দুটো কেসই কাগজের ভিতরের পাতায় সরু কলামে চলে গেল। আসলে নৃশংসতায়, ভয়াবহতায়, একেবারে দিল্লির বুকের ওপর ঘটা ঘটনা হিসেবে আমার কেসটার কোনও জুড়ি নেই যে! |
|
ভরসার আলো? যন্তরমন্তর, দিল্লি, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১২। ছবি: পি টি আই |
মেয়েদের উপরে যে হিংসার ঘটনা ঘটে, পথেঘাটে, বাড়িতেও, সেটা মেয়েদের নিজস্ব ব্যাপার বলেই জানে সবাই। পুলিশ, কোর্ট, প্রসিকিউটর সকলে। যাদের ব্যাপার, তারাই সামলাক। হয় ঘরে বসে থাকুক, নয় বাইরে বেরিয়ে লাঞ্ছনা ভোগ করুক। যে ব্যাপারটাকে পুলিশ আর আদালত মনে করে মেয়েদের সমস্যা, তাতে কারও কোনও শাস্তি শেষ পর্যন্ত হয় না। গড়পড়তা অপরাধীও সেটা জানে।
আচ্ছা, তবে এত দিনে কী পেলাম আমরা? আমার বয়স তো মাত্র তেইশ, আড়াই দশকও দেখিনি দুনিয়াটাকে। দেখছি যে, শিক্ষা, সাহস, বুদ্ধি, কারিগরি মেধা কোনও কিছু দিয়েই হিংসাকে ঠেকানো যাচ্ছে না। অথচ যাঁরা বয়সে বড়, নারীমুক্তি আন্দোলন করেছেন, মেয়েদের জন্য সাংবিধানিক সংগঠন দাবি করেছেন, মেয়েদের জন্য আইনের নিয়মিত সংশোধন— সে কাজ চালু করতে পেরেছেন, তাঁরাও হতাশ। সংগঠনগুলি আর কাজ করে না। তাদের অর্থ, লোকবলের অভাব। তারা দক্ষ মানুষ পায় না। রাজনীতি, দল গঠনের রাজনীতি— এদের ছোট করে, প্রান্তিক করে রেখে দিয়েছে। এরাই আবার পুলিশকে বলে না যে, নারীর প্রতি হিংসার বিরুদ্ধে পদক্ষেপগুলিকে ফৌজদারি ব্যবস্থার মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন কোরো না। বড় বড় পুলিশ অফিসাররা বলছেন, আমাদের কাছে লোকবল নেই, যথেষ্ট সামর্থ্য নেই নারীর বিরুদ্ধে হিংসার মোকাবিলা করি।
তবে যে আজ জাস্টিস বর্মা কমিশন তৈরি হল, তোমাদের আন্দোলনের চাপের কাছে মাথা নত করে তার উদ্দেশ্য বলা হল— মেয়েদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত ফৌজদারি আইন সংশোধন নিয়ে মতামত নেওয়া— এর মধ্যে নতুন কী আছে? এক মাসে এ কাজ হবে কীকরে? মহিলা কমিশন, ল’ কমিশন যে কাজ করেছে, তার পরবর্তী ধাপগুলো চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের দায় কোথায়?
ভাগ্যিস আমার উপর অত্যাচার অতটা নৃশংস হয়েছিল! নইলে তোমরা সবাই আজ কোথায়? কালকাজির ওই মহিলার মতো কেবল ধর্ষণ করে রাস্তায় ফেলে দিলে পুলিশ হয়তো আমার অভিযোগই নিত না। অভিযোগ না নেওয়া, ভুল ভাবে অভিযোগ দায়ের করা, দুর্ব্যবহার, অশালীন মন্তব্য, সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহে গাফিলতি, ডাক্তারি পরীক্ষা সময়মতো না করানো... এর পর যদি চার্জশিটও হল, তার পর পাবলিক প্রসিকিউটার-এর ঔদাসীন্য, এর পর তদন্তকারী অফিসারের বদলি... বিচার পাওয়ার রাস্তা যেন আক্রান্ত মেয়ের জন্য এক হার্ডল রেস। থানায় আজ একা একটা মেয়ে যেতে পারে অভিযোগ দায়ের করতে? নিজের পোশাক, চরিত্র, অতীত নিয়ে কোনও মন্তব্য না শুনে? অভিযোগ না নিয়ে তাকে মহিলা থানার দিকে যেতে বলে দিতে পারে পুলিশ। কারণ, নারী-হিংসা তো শেষ পর্যন্ত মেয়েদেরই নিজস্ব ব্যাপারস্যাপার।
ভোরের আলো ফুটছে। দিল্লির রাস্তায় ঘন কুয়াশার মধ্যেই নামছে চল্লিশ কোম্পানি প্যারামিলিটারি। এত, এত সুরক্ষাবল? সব ক’টা মেট্রো স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যাতে জমায়েত না হতে পারে। এ সব ভাল না মন্দ ঠিক বুঝতে পারছি না। কই, কোনও রাজনীতির জনপ্রিয় নেতা এসে তো দাঁড়ালেন না তোমাদের সামনে, তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে! একটা বিশেষ অধিবেশন ডাকা হতে পারত পার্লামেন্টের, তা-ও তো হল না! তবে কি এ বারও রাজনীতি কোণঠাসা করে দিল বদলাতে থাকা সমাজের বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা স্বপ্নকে? ভোট-রাজনীতি বদলাতে চায় না, কিন্তু সমাজ যদি চায়? যদি সমাজ বলে, আমরা নারীর প্রতি হিংসাকে আর দৈনন্দিন জীবনের অংশ বলে মেনে নিতে চাই না? রাজনীতি কথা শুনবে না, যেহেতু মোমবাতি-হাতে দাঁড়িয়ে থাকা, জলকামান খাওয়া তোমরা ভোটব্যাঙ্ক নও?
কুয়াশা-ঢাকা রাজধানীর ঠান্ডা বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে আমার প্রাণ। আচ্ছা, আমাকে দেশে মরতে দিতে পারলে না তোমরা? জানতে চেয়েছিলে আমি কী চাই? অত জ্বর, রক্তক্ষরণ, ফুসফুসে সংক্রমণ— সত্যিই কি অন্ত্র প্রতিস্থাপনের জন্য এত তাড়া ছিল? বাবা মায়ের আশা মেটাতে যে শহরে এসেছিলাম পড়তে, সেখানে আমি শেষ রাতটা কাটাতে পারলাম না!
চল্লিশ কোম্পানি প্যারামিলিটারি দিয়েও আমার এখানে থেকে যাওয়া, এ দেশের মাটিতে মরা— এ সব সামলানো যেত না?
না, ফোর্স দিয়ে সব কিছু সামলানো যায় না। তবু তেইশ বছরের অপূর্ণ সাধ-আহ্লাদ তো! যদি একটা পুলিশ প্যাট্রল ধরতে পারত বন্ধ আমাদের বাসটাকে, যদি কন্ট্রোল রুম নিত প্রথম ওই এফ আই আর-টা— মারধর খেয়ে বাস থেকে পড়ে যাওয়া লোকটার! যদি ঠান্ডা রাস্তায় বিনা কাপড়ে
পড়ে না থাকতে হত দু’তিন ঘণ্টা! লোকে দাঁড়িয়ে অচেতন আমাদের রক্তপাত দেখেছে, অথচ কেউ তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। কেউ একটা জামা কি জ্যাকেট দেয়নি গা
থেকে খুলে।
কিছুই তো হয়নি সে দিন সন্ধেবেলা! সুন্দর সন্ধেটা, পি ভি আর-এ থ্রি-ডি সিনেমা, হলের মধ্যে হাসাহাসি, এ-ওর কাঁধে মাথা— বেরিয়ে এসে হাঁটতে হাঁটতে পেলাম ফ্লাইওভারের নীচে কালো কাচের জানালা দেওয়া খালি বাসটা। মরণ ছিল ওর মধ্যে, আর এত যন্ত্রণা— বাসটা ঘুরছে, ঘুরছে শহরের মধ্যে, পি সি আর, কন্ট্রোল রুমের নাকের উপর দিয়ে। ভিতরে আমরা দু’জন রক্তাক্ত, যন্ত্রণায় ছটফট করছি, কেউ শুনতে পাচ্ছে না আমাদের কান্না, চিৎকার। আচ্ছা, কী অদ্ভুত, শেষ পর্যন্ত ওদের নিজেদের অঙ্গে কুলোল না, নিয়ে এল একটা জং ধরা লোহার রড। নিজেদের পুরুষত্বেও কি ওদের ভরসা নেই?
আজ আমার শেষ ইচ্ছে জানাই। আমি আবার জন্মাব। এ দেশেই। আবার আক্রান্ত হব। নিপীড়ন, ব্যঙ্গ সইতে না পেরে নিজের জীবন নেব না আমি। আমি লড়ব। থানা যদি অভিযোগ না নেয়, মহল্লা আর গ্রামের লোক এনে ঘিরে ফেলব থানা। আইনজীবী, হাসপাতাল, সমাজ সংগঠনের লোকের নাম থাকবে ব্যাগের ডায়েরিতে। যে পলিটিকাল পার্টি হিংসার দায়ে দোষীদের দাঁড় করায়, তাদের বয়কট করব। ত্যাগ করব তাদের, যারা নারীর প্রতি হিংসাকে আচরণে, ভাষায়, লেখায় সমর্থন করে। সন্তান, ভাই, বাবা, বন্ধুকে শামিল করব হিংসামুক্ত জীবনের অধিকার-আন্দোলনের। ইভটিজার, শ্লীলতাহানি করা মস্তান, ধর্ষকদের নাম ও ছবি টাঙাব দেওয়ালে। কেবল নৃশংস, ভয়ানক ঘটনা, যা মৃত্যু ঘটায়, তা-ই নয়, সারা দেশে, গ্রামেগঞ্জে, যেখানে নারী আক্রান্ত, তাদের পাশে দাঁড়াব। আর হ্যাঁ, দুটো শব্দ এ বার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সময় এসেছে: অত্যাচারের আগে ‘পাশবিক’, কারণ পশুরা আপত্তি করছে। আর মেয়ের আগে ‘ধর্ষিতা’ ‘নিপীড়িতা’ ‘লাঞ্ছিতা’। আমাদের বল আক্রমণ-উত্তীর্ণা!
ইস্পাতের যোনি নিয়ে জন্মাব এ বার; লোহার পাতে মোড়া শরীর নিয়ে। আমার আলিঙ্গনের চাপে চুরমার হয়ে যাবে হিংসক। আর, যত দিন না জন্মাই আবার, আমার বাবা, মা, দুটো ভাই আর বন্ধুটার মতন, যারা নিজেদের মেয়েটাকে হারাল বা রক্তমাখা ফেরত পেল— তাদের একটু সঙ্গে সঙ্গে থেকো। |
|
|
|
|
|