|
|
|
|
‘টেনশন-ফ্রি’ ছবির প্রদর্শনী দেখে আপ্লুত শিল্পী-মমতা |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রাতের স্বপ্নে’র দাম তিন লক্ষ টাকা।
শুনে একটু থমকালেন প্রৌঢ়া মেমসাহেব। তার পর ভেবেচিন্তে বললেন, “ঠিকই আছে। একটা ছবি অন্তত নেওয়াই যায়।”
গাঢ়-রঙা ক্যানভ্যাসে জমকালো উজ্বল ফুল। যোগেন চৌধুরী যার নাম রেখেছেন, ‘ড্রিম অফ নাইট’। কালো পটভূমিতে এক গুচ্ছ রঙিন ফুলের আরও একটা ছবি ছিল। দু’টো মধ্যে ‘রাতের স্বপ্ন’কেই জুন টমকিন্সের মনে ধরে গেল।
আদতে ব্রিটিশ নাগরিক, এই মহিলার সঙ্গে কলকাতার সম্পর্ক অনেক দিনের। দক্ষিণ কলকাতার একটি রূপচর্চা কেন্দ্রের কর্ত্রী। তবে নিজেকে মনে-প্রাণে ভারতীয় বলতেই ভালবাসেন। এ রাজ্যের শিল্পী-মুখ্যমন্ত্রীর ছবির খবর নিতে বুধবার সকাল থেকেই হন্যে হয়ে খোঁজ করছিলেন তিনি।
টাউন হলের প্রদর্শনী, ‘স্বপ্নসন্ধানীর সৃষ্টি’ (আ ড্রিমার্স ক্রিয়েশন)। চলবে ১৫ দিন ধরে। যথার্থ শিল্পরসিক আমেরিকান-ইউরোপিয়ানরা, যেমন হিলারি ক্লিন্টন, মমতার ছবি দেখেননি বলে এ দিন আফশোস করছিলেন মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ শিল্পী শুভাপ্রসন্ন। বিদেশিনি জুন একটু বাদেই তাঁর পছন্দের ছবিটি বাছাই করলেন।
যদিও মুখ্যমন্ত্রীর ছবির ক্রেতা-তালিকা আগে থেকেই ঠিক হয়ে গিয়েছে বলে রটনার জেরে ক্ষুব্ধ উদ্যোক্তারা। উদ্বোধনী সন্ধেয় বিক্রিবাটার দিকে যেতে চাইলেন না তাঁরা। তবে ৮-৯ জন ক্রেতা ছবি পছন্দ করে গিয়েছেন বলে মেনে নিচ্ছেন। আজ, বৃহস্পতিবার থেকে কেনাকাটা শুরু হবে। |
|
রঙের দেশে:
নিজের ছবির প্রদর্শনীতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে শুভাপ্রসন্ন ও যোগেন চৌধুরী। |
সিপিএমের তরফে গৌতম দেবের কিন্তু দাবি, ছবির ক্রেতাদের নাম প্রকাশ্যে আসা উচিত। তাঁর কথায়, “আগেও তিন বার ওঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। ক্রেতাদের নাম জানা যায়নি।” ছবির গুণমান নিয়ে মন্তব্য করতে না-চাইলেও স্বচ্ছতার স্বার্থে মমতার ছবির ক্রেতাদের নাম প্রকাশ্যে আসা উচিত বলে তাঁর মত। এই ছবি বিক্রি প্রকারান্তরে তোলাবাজি বলে কটাক্ষ করেছিল সিপিএম।
ছবি আঁকা তাঁর নেশা হলেও এর পিছনে একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে বলে বারবার দাবি করেছেন মমতাও। হয় ভোটের খরচ, নয়তো দুর্গতদের সাহায্য করতেই ছবি বিক্রির টাকাটা খরচ করা হয়। এ দিনও তিনি বলেন, “সামনে পঞ্চায়েত ভোট। দলের টাকা নেই। ছবি বিক্রি করে সবটা হয় না। যদি পোস্টার, প্রচারের খরচ কিছুটা উঠে আসে।”
শীতের শহরে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য আমজনতাকে নিছক আনন্দের জন্যই তাঁর ছবি দেখে ফুরফুরে হতে বলেছেন। তাঁর কথায়, “এ হল টেনশন-ফ্রি ছবি। আসুন, দেখুন, রিল্যাক্স করুন।”
মমতা কি মিকেলেঞ্জেলো না পিকাসো, বলে একদা বিদ্রুপ করেছিলেন গৌতম দেব। ‘পরিবর্তনপন্থী’ বলে চিহ্নিত শিল্পী যোগেন চৌধুরী কিন্তু মমতার ছবিকে প্রশংসার শিখরে বসিয়েছেন। তিন থেকে এক লক্ষ টাকায় বড়-মেজো-সেজো মাপের ছবির দাম শুভাপ্রসন্ন ঠিক করেছেন। দাম শুনে সোদপুরের সুপর্ণা ও সুদীপ্তা গোস্বামীর চোখ অবশ্য কপালে উঠল। ‘দিদির ছবি’ আরও সসম্ভ্রমে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মা-মেয়ে।
সাধারণত, নিজের কাজের বিষয়ে ‘ভূতের মতো খাটছি’ বা ‘পাঁচ বছরের কাজ এক বছরে করেছি’ গোছের কথা বলতেই ভালবাসেন মুখ্যমন্ত্রী। নিজের ছবির বিষয়ে কিন্তু বিনয়ী শিল্পীর মন্তব্য, “এটা ক্যাজুয়াল ওয়র্ক (খেলাচ্ছলে আঁকা)। আমি খুব ফাঁকিবাজ। ১০-১৫ মিনিটে মেরে দিয়েছি।” যোগেন চৌধুরী তবু প্রত্যয়ী, “ছবিতে স্ব-শিক্ষিত স্বতঃস্ফূর্ত শিল্পী মমতার অবদান থেকে যাবে।” আর শুভাপ্রসন্ন এ দেশে এমন পরিশ্রমী নেতা, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির সর্বোচ্চ পর্যায়ে এতটা নান্দনিক বোধ আগে দেখেননি।
সংস্কৃতি-জগতের কোনও অনুষ্ঠানে সাধারণত মুখ্য আপ্যায়নকারিণী থেকে সঞ্চালক--- একাই একশো হয়ে ওঠেন মমতা। নিজের ছবির প্রদর্শনী মেয়র ও শিল্পীরা উদ্বোধন করার সময়ে লজ্জায় এক ধারে সরে থাকলেন। বিতর্ক এড়াতে স্পষ্ট বলে দিলেন, এটা সরকারি অনুষ্ঠান নয়। পুরসভাকে রীতিমতো টাকা গুনে টাউন হলের সংযুক্ত ভবনের পাতালঘরটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। |
|
মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ‘ড্রিম অন রোজ’। |
বক্তৃতা-পর্ব মিটতে যোগেনদা-শুভাদাকে দু’পাশে নিয়ে নিজের ছবি দেখতে দেখতে প্রায় কিশোরীর উচ্ছ্বাসে ভাসলেন মমতা। খ্যাতনামাদের মুখে তাঁর বলিষ্ঠ স্ট্রোকের প্রশংসা। আর ‘গ্রে ফ্লাওয়ার্স’-এর সামনে দাঁড়িয়ে শিল্পী বলছেন, “স্যাটাস্যাট মেরে দিয়েছি।” একটি ছবিতে ফুলগাছের নীচে হাতির আভাস। সে দিকে তাকিয়ে মন্তব্য, ‘হাতি মেরে সাথী।’ গোলাপ-রঙা পটে ধানের ছবিটিও শিল্পীর বড় আদরের। ছবির নাম ‘ড্রিম অন রোজ’। শ্রমিক শাখার নেত্রী দোলা সেনকে ডেকে দেখালেন, “ধান সব সময়ে আমার ভাবনায় থাকে।”
শিল্পীর শাড়ি নিরাভরণ নীল-সাদা। কিন্তু দর্শকদের মুখে তাঁর রং ব্যবহারের প্রশস্তি। সিঁদুর-রঙা নারীর মুখাবয়বের সামনেও অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে মমতা। ছবির নাম ‘ফ্যান্টাসি উইথ রেড সান’। “আরে, আমার সাদা ময়ূর কোথায় গেল। ওটা রাখিসনি!” আয়োজকেরা হন্তদন্ত হয়ে সেই ছবি নিয়ে এলেন। ভাস্কর তারক দাস ও তাঁর স্ত্রী চিত্রশিল্পী মীনাক্ষি গড়াই এগিয়ে এসে বলে গেলেন, ‘কী উজ্জ্বল রং!’
মিটিংয়ে ফাঁকতালে বা মহাকরণে অবসর সময়েও ছবি আঁকেন মমতা। প্রদর্শনীর শ’দেড়েক ছবিই ২০১২ সালের সৃষ্টি। “ব্যস্ততার মধ্যে এই সৃজনশীলতা অতুলনীয়। মুখ্যমন্ত্রী নয়, শিল্পী মমতার ছবি দেখুন!” এ কথা বলেই উদ্বোধনী-মঞ্চে শিল্পরসিকদের আহ্বান জানিয়েছিলেন শুভাপ্রসন্ন। কিন্তু দিদির ছবির ব্যাপারটা যে আলাদা, সেটা ফেলতে পারছেন না প্রদর্শনীর শিল্পমোদীরা। বেলুড়ের দম্পতি প্রসেনজিৎ ও শর্বরী সিংহের কয়েকটি গাছ-ফুলের ছবি দারুণ পছন্দ। প্রসেনজিৎ বললেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সইটারও একটা মূল্য আছে। পরে এই ছবির চাহিদা আরও বাড়তে পারে।”
|
—নিজস্ব চিত্র |
|
|
|
|
|