বীরভূমে চাষিদের একটা অংশ এ বছর সরকার নির্ধারিত সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রি করতে চাইছেন না। তাঁরা স্থানীয় ফড়ে বা আড়তদারদের কাছেই নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। অর্থাৎ, অভাবী বিক্রি ঠেকানো যাচ্ছে না চলতি মরসুমেও। মূলত গত বছর নির্ধারিত সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রি করতে গিয়ে ‘তিক্ত’ অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতেই তাঁদের এই সিদ্ধান্ত বলে চাষিদের দাবি।
কেমন সেই অভিজ্ঞতা?
গত বার ধানের সহায়ক মূল্য ছিল ১০৮০ টাকা প্রতি কুইন্টাল। অথচ আড়তদার কিংবা ফড়েদের কাছে ধানের দাম মিলেছিল প্রতি কুইন্টালে মাত্র ৭৫০-৮০০ টাকা। কিন্তু ফড়ে, আড়তদারদের উপেক্ষা করে সহায়ক মূল্য পাওয়ার জন্য চালকলে ধান বিক্রি করতে গিয়ে খুব ‘শিক্ষা’ হয়েছিল ময়ূরেশ্বরের লোকপাড়ার চাষি উদয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁর কথায়, “লোকপাড়া থেকে কাছাকাছি সাঁইথিয়া চালকলের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। কুইন্টাল প্রতি ২০ টাকা ট্রাক্টর ভাড়া করে, ধান তোলা ও নামানোর খরচ বাবদ ২০ টাকা করে দিয়ে, খাওয়া খরচ বাবদ খরচ জোগান দেওয়া-সহ সারাদিন পরিশ্রম করে ১২ কুইন্টাল ধান চালকলে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে কুইন্টাল প্রতি পাঁচ কেজি হারে ‘বাটা’ কেটে নেওয়ার পর ‘অ্যাকাউন্ট পেয়ি’ চেক হাতে পেয়েছিলাম।” তাঁর সংযোজন, “সেই চেক ভাঙাতে ব্যাঙ্ক আবার ১৫০ টাকা কেটে নিয়েছিল। টাকা মিলেছিল আরও ২০-২৫ দিন পর!”
“এর পরও বলছেন সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রি করতে যাব?” তেতো গলায় বলছেন উদয়বাবু। |
একই অভিজ্ঞতার পর এ বারে চালকলে সরকার নির্ধারিত ১২০০ টাকা সহায়ক মূল্যের পরিবর্তে স্থানীয় আড়তে ৯৬০-৯৭০ টাকা কুইন্টাল প্রতি দরেই ধান বিক্রি করে দিয়েছেন বুজুংয়ের প্রদীপকুমার মণ্ডল। তাঁর দাবি, “সহায়ক মূল্যে চালকলে ধান বিক্রি করতে গিয়ে ‘ধুতে-বাছতে’ উদ্বৃত্ত বিশেষ কিছু থাকে না। তাও নগদ টাকা পেলে কথা ছিল। চেক ভাঙিয়ে টাকা পেতে ২০-২৫ দিন লাগবে। তত দিন বসে থাকলে টাকার অভাবে তো রবি চাষই হবে না!”
চাষিদের আরও অভিযোগ, তাঁদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার পরিবর্তে আড়তদার কিংবা ফড়েদের কাছ থেকেই ধান কিনতে বেশি আগ্রহী চালকল মালিকেরা। লাভপুরের ধনডাঙা গ্রামের চাষি বিবেকানন্দ মণ্ডলের অভিযোগ, “ওই কারণে অনেক চালকল কর্তৃপক্ষই ‘ধান খারাপ’ কিংবা ‘কেনার লোক’ নেই এমন সব অজুহাত দেখিয়ে ধান কিনতে চাইছেন না।” চাষিদের একটা বড় অংশেরই আবার অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রেই নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী তাঁদের টাকা দেওয়া হয় না। আর এক চাষি ময়ূরেশ্বরের নবগ্রামের বংশীবদন মণ্ডলের কথায়, “ওই সব অভিজ্ঞতার জেরে অনেক সময়ই আমরা ধান বিক্রি করতে নিয়ে গিয়ে বিফল হয়ে বাড়ি ফিরি এসেছি। ফেরার পথে অনেকে আবার খোলা বাজারেই ধান বিক্রি করে আসতেও বাধ্য হয়েছেন।”
চালকলগুলির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অনেকটাই অস্বীকার করছেন জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি দীপক প্রামাণিক। তাঁর বক্তব্য, “সরকারি হিসেব অনুযায়ী এক কুইন্টাল ধান থেকে ৬৮ কেজি চাল পাওয়ার কথা। কিন্তু, এ জেলায় ৬০ কেজির বেশি চাল মেলে না। সে ক্ষেত্রে ধানের গুণমান অনুযায়ী দাম তো কম হবেই।”
এ বার দেখা যাক, জেলায় সহায়ক মূল্যে চাল কেনার কী হাল। জেলা কৃষি দফতর সূত্রের খবর, এ বার জেলায় আউস ও আমন ধান উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৪ লক্ষ টন। সরকারি সহায়ক মূল্যে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা আড়াই লক্ষ টন। চালকল ছাড়া বীরভূমে এখনও পর্যন্ত সরকারি সহায়ক মূল্যে ধান কেনার তেমন কেন্দ্রই খোলা হয়নি। জেলায় এখনও পর্যন্ত ৭৬টি চালকল এবং সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ সোসাইটির মাধ্যমে সিউড়ির পুরন্দরপুরে তিন দিন ও মহম্মদবাজারে জোনাল কো-অপারেটিভ সোসাইটির মাধ্যমে তিন দিনের শিবির করে এ পর্যন্ত মাত্র ৫৭ হাজার টন ধান কেনা হয়েছে।
প্রাদেশিক কৃষকসভার জেলা সম্পাদক আনন্দ ভট্টাচার্যের অভিযোগ, “ব্লক থেকে জেলা স্তর পর্যন্ত বেশির ভাগ এলাকাতেই সহায়ক মূল্যে ধান কেনা চালু হয়নি। অনেক চাষি ইতিমধ্যেই অভাবে পড়ে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এর পর যখন ধান কেনা চালু হবে তখন বড় চাষি, আড়তদার কিংবা ফড়েরা নামে-বেনামে সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রির সুযোগ হাতিয়ে নেবেন।” জেলা খাদ্য সরবরাহ নিয়ামক বাপ্পাদিত্য চন্দ্র অবশ্য বলেন, “শীঘ্রই সাঁইথিয়ায় তিনটি শিবির করে ধান কেনা হবে। বহু সমবায় সমিতির সঙ্গেও কথা চলছে। |