লোহাচুরিতে যে এক শ্রেণির পুলিশকর্মীর যুক্ত থাকার অভিযোগ ওঠে, রানিগঞ্জের একটি ঘটনায় তা একেবারে সামনে চলে এল।
লোহাচুরিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ ওঠায় বুধবার আসানসোল আদালত থেকে জামিন নেন রানিগঞ্জ থানার এক পুলিশ কনস্টেবল তথা গাড়িচালক। স্বপন দাস নামে ওই পুলিশকর্মী অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা আসলে রানিগঞ্জে লোহাচুরির রমরমার প্রমাণ বলেই স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি বড় অংশের ধারণা।
গত ৩১ ডিসেম্বর বন্ধ হয়ে থাকা বার্ন স্ট্যান্ডার্ড ইউনিটের নিরাপত্তারক্ষী লক্ষ্মীদেবী রানিগঞ্জ থানায় দায়ের করা অভিযোগে জানান, সে দিন দুপুর দেড়টা নাগাদ পুলিশকর্মী স্বপন দাস অপরিচিত দুজনকে সঙ্গে নিয়ে এসে ভাঙা পাঁচিল দিয়ে লোহা বের করে ভ্যানে চাপাচ্ছিলেন। বাধা দিতে গেলে তিনি বলেন, ‘রানিগঞ্জ থানার বাজেয়াপ্ত করা সামগ্রী আমি নিয়ে যাচ্ছি। পুলিশকর্মী হিসাবে নিয়ে যেতেই পারি। তোদের বলার কী আছে?’
পরে স্বপনবাবুর বিরুদ্ধে চুরির মামলা দায়ের করে আদালতে পাঠানো হয়। কিন্তু পুলিশ তাঁকে হেফাজতে না চাওয়ায় তাঁর জামিন মঞ্জুর হয়ে গিয়েছে। সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য তুফান মণ্ডল, বিজেপি-র আসানসোল জেলা সম্পাদক পবন সিংহদের দাবি, “ওই পুলিশকর্মীকে হেফাজতে নিয়ে জেরা করলেই বেরিয়ে পড়বে, পুলিশের কোন কোন বড়কর্তা লোহাচুরিতে যুক্ত। সে কারণেই তাঁকে হেফাজতে চাওয়া হয়নি।” তৃণমূলের রানিগঞ্জ ব্লক সভাপতি সেনাপতি মণ্ডলের প্রশ্ন, “রক্ষকই যদি ভক্ষক হয়, চুরি কে আটকাবে?”
তবে আসানসোল-দুর্গাপুরের এডিসিপি (সেন্ট্রাল) সুরেশ কুমার চাডভিয়ার ব্যাখ্যা, “আসামির পালিয়ে যাওয়ার বা ফের অপরাধ করার সম্ভাবনা থাকলে আমরা জামি নের বিরোধিতা করি। এক জন পুলিশকর্মী চাকরি ছেড়ে পালিয়ে যাবেন? আমাদের নজরে তো উনি সব সময়েই থাকছেন। ফের অপরাধ করার উপায় নেই। তদন্তের স্বার্থে চাইলে যে কোনও সময়ে জেরাও করা যেতে পারে। তাই আমরা ওঁকে পুলিশ হেফাজতে চাইনি।”
কনস্টেবলের বিরুদ্ধে এই মামলা কিন্তু প্রকৃত পক্ষে রানিগঞ্জে লোহাচুরির ব্যাপকতা সামনে এনে দিয়েছে। স্থানীয় সূত্রের খবর, কুমারবাজার গ্যাস ফ্যাক্টরির সামনে চলছে সবচেয়ে বড় লোহার কাঁটা (যেখান থেকে চোরাই কারবার চলে)। নেতৃত্বে কালী, পাপ্পু এবং ইদু। বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের বন্ধ হয়ে যাওয়া ইউনিট এবং রানিগঞ্জ স্টেশনের মালগাড়ি থেকে প্রকাশ্যে লোহা কেটে পিক আপ ও ঠেলা ভ্যানে ভোর ৫টা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে ওই কাঁটায় জমা করা হয়। বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের লোহা যায় রনাই গ্রামে দৌলত, আমজাদ, ছোটু এবং গুজ্জাদের কাঁটায়। ওই চার কাঁটার লোহা পাচার হয় বিভিন্ন ছোট কারখানা থেকে কলকাতা পর্যন্ত।
অন্য দিকে নিমচা, দামালিয়া বা হাড়াভাঙায় নির্দিষ্ট কোনও কাঁটা নেই। লোহাচোরেরা বিভিন্ন বন্ধ খনি থেকে লোহা কেটে পিক আপ কিংবা ঠেলা ভ্যানে দামোদর নদ পার করে পাচার করে বাঁকুড়ার মেজিয়া টেলিফোন এক্সচেঞ্জের পিছনে। সেখানে কাঁটা চলে মল্লুর নেতৃত্বে। পঞ্জাবী মোড়ে গফরের কাঁটাতেও অবৈধ লোহার রমরমা কারবার। কুমারবাজারের বাসিন্দারা আগেই পুলিশের কাছে জানিয়েছিলেন, অবৈধ লোহা পরিবহণের বেপরোয়া যান চলাচলে তাঁরা আতঙ্কিত। কোনও প্রতিকার মেলেনি। কোয়ারডি কোলিয়ারি কর্তৃপক্ষ জানান, গত শুক্র, শনি ও রবিবার দুষ্কৃতীরা তাঁদের খনি চত্বরে হানা দিয়েছিল। প্রথম দিন নিরাপত্তারক্ষীদের তাড়ায় তারা কয়েকটি রড নিয়ে পালিয়ে যায়। পরের দিন রক্ষীরা শূন্যে গুলি ছুড়লে তারা সিলিন্ডার ও একটি মোবাইল ফেলে পালায়। রবিবার বিদ্যুতের চালু লাইন থেকে দুশো মিটার তার কেটে নিয়ে যায়।
খনি কর্তৃপক্ষের আক্ষেপ, বারবার অভিযোগ দায়ের করা সত্ত্বেও পুলিশ দুষ্কৃতীদের নাগাল না পাওয়ায় খনিকর্মীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। এডিসিপি (সেন্ট্রাল) অবশ্য আশ্বাস দেন, লোহাচুরির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযান চলছে। দ্রুত দুষ্কৃতীরা ধরা পড়বে। অভিযুক্ত যেই হোক, আইন আইনের পথেই চলবে। কাউকে রেওয়াত করা হবে না। |