কড়া চিঠি সিএজি-র |
‘নিরুদ্দেশ’ হাজার কোটির
হিসেব পায়নি অর্থ দফতর
জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
|
|
রাজ্যের রাজকোষে হাড়ির হাল। অথচ প্রায় হাজার কোটি টাকার হিসেব নেই!
কেন? সরকারের বিভিন্ন দফতর নানা কারণ দেখিয়ে কোষাগার থেকে অগ্রিম হিসেবে টাকা তোলে। অথচ তার হিসেব দাখিল করে না বলে অভিযোগ। সম্প্রতি কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)-এর অফিস থেকে হিসেব না-মেলা ওই টাকার বিষয়ে অর্থ দফতরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ক্যাগ আশঙ্কা করছে, বিপুল পরিমাণ টাকা এই ভাবে তছরুপ হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। সিএজি-এর কথা শুনে অর্থ দফতর অগ্রিমের হিসেব চেয়েও পাঠিয়েছে। কিন্তু তার পর দু’মাস কেটে গিয়েছে। কোনও দফতরই এখনও হিসেব দাখিল করতে পারেনি। ফলে সিএজি-এর আশঙ্কা সত্য হতে পারে বলে স্বীকার করছেন অর্থ দফতরের কর্তাদেরই একাংশ।
অর্থ দফতরের কর্তারাই জানাচ্ছেন, অগ্রিম নেওয়া প্রায় ৯৭০ কোটি টাকার হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না। গত দশ-বারো বছর ধরেই হিসেব অমিল। এমনকী ১৯৯৩-’৯৪ সালেরও কিছু হিসেব বকেয়া রয়েছে। প্রতি অর্থবর্ষের শেষেই অর্থ দফতর অন্যান্য দফতরের কাছে অগ্রিম নেওয়া টাকার হিসেব তলব করে রুটিন চিঠি দেয়। কিন্তু কোনও দফতরই হিসেব পেশ করে না। অর্থ দফতরও তার পর আর কোনও ব্যবস্থা নেয় না বলে অভিযোগ। এই রকম জোড়াতালি দিয়েই এত দিন চলেছে। সিএজি-ও এর আগে কয়েক বার চিঠি দিয়েছে। কিন্তু এ বারের মতো কড়া চিঠি এর আগে পাঠায়নি তারা। তছরুপ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথাও সিএজি এত খোলাখুলি আগে বলেনি বলে অর্থ দফতর সূত্রেই খবর।
অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল (অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড এনটাইটেলমেন্ট) দীপক অনুরাগ রাজ্যের অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে সম্প্রতি চিঠিতে কড়া সুরে লিখেছেন ‘‘হিসেব না-পাওয়া টাকার পরিমাণ নেহাত কম নয়। এই ঘটনা রাজ্যের আর্থিক ব্যবস্থায় চরম অনিয়ম এবং গলদ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। আর্থিক পরিচালন ব্যবস্থার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ যে দুর্বল, সেটাও এতে পরিষ্কার।’’ চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে যদি কোষাগারের টাকার হিসেব পাওয়া না যায়, তা হলে তছরুপের আশঙ্কা থেকেই যায়। অবিলম্বে ওই টাকার হদিস বার করুক রাজ্য সরকার।’’
সিএজি-র চিঠি পাওয়ার পরে নড়েচড়ে বসেছেন অর্থসচিব। সব দফতরের কাছে বিভিন্ন সময়ে অগ্রিম নেওয়া টাকার হিসেব চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। তার দু’মাসের মধ্যেও কোনও দফতর অগ্রিম টাকার হিসেব অর্থসচিবকে দিতে পারেনি। ফলে সিএজি-র কাছেও কোনও জবাব পাঠাতে পারেনি মহাকরণ। অর্থ দফতরের এক মুখপাত্রের কথায়, “নিয়মের ফাঁক গলে বেশ কিছু দফতর অগ্রিম নেওয়াটা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে। আর্থিক শৃঙ্খলা ফেরাতে এ বার অগ্রিম নেওয়ার ব্যবস্থাটাই বন্ধ করতে হতে পারে।” |
অর্থ দফতর সূত্রেরই খবর, ৯৭০ কোটির সিংহভাগই অগ্রিম হিসাবে তোলা হয়েছে বাম আমলের শেষের দিককার বছরগুলোয়। তবে গত দেড় বছরে নতুন সরকারের আমলে অগ্রিম তোলার প্রবণতা বাম জমানার চেয়েও বেড়েছে বলে জানাচ্ছেন অর্থ দফতরের কর্তারা। তাঁদের দাবি, পরিবর্তনের পরে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকা অগ্রিম তোলা হয়ে গিয়েছে। এবং যথারীতি তার হিসেব জমা পড়ছে না। অর্থ দফতরের রেকর্ড বলছে, সবচেয়ে বেশি অগ্রিম তুলেছে স্বরাষ্ট্র এবং বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর। ৬৮১ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা। ৩৮৫৩টি বিলের মাধ্যমে তারা ওই অগ্রিম নিয়েছে। অন্য যে সব দফতরের মোটা অঙ্কের হিসেব বকেয়া রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন, তথ্য ও সংস্কৃতি, সমাজকল্যাণ, শিশু ও নারীকল্যাণ, স্বাস্থ্য, কৃষি বিপণন এবং খোদ অর্থ দফতর।
এত দিন বিষয়টি নিয়ে কেউ নড়েচড়ে বসেনি কেন? বাম আমলের অর্থ দফতরের এক প্রাক্তন কর্তা দাবি করেন, “এ সব বিষয় অর্থমন্ত্রী স্তরে কখনও যেত না। সিএজি-র চিঠি পেলে অফিসারেরাই ব্যবস্থা নিতেন। অর্থ দফতরের অফিসারেরা হিসেব পেতে জেলা প্রশাসনকে নিয়মিত তাগাদা দিতেন।” ওই কর্তার বক্তব্য, তিন-চার জন জেলাশাসক এবং কয়েক জন পুলিশ সুপার সময়ে হিসেব দেননি।
প্রশ্ন উঠেছে যদি সামান্য কয়েক জন হিসেব না দিয়ে থাকেন আর অর্থ দফতরের কর্তারা ব্যবস্থা নিয়েই থাকেন, তা হলে হিসেব না-মেলা টাকার এই বিপুল অঙ্ক জমল কী করে? রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, বেনিয়ম হয়েছে কি না তা এখনও বলার সময় আসেনি। “সিএজি চিঠি দিলেই হল না। কোনও বেনিয়ম হয়েছে কি না, তা বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির বিবেচনায় আসে। তাদের মতামত নেওয়ার পরেই সিএজি-র রিপোর্ট চূড়ান্ত হয়। আগে সেই কাজটা হোক, তার পর আমাদের বক্তব্য জানাব।” রাজ্যের বর্তমান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের বক্তব্য জানার জন্য বারবার চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
কোন কোন খাতে নেওয়া হল কোটি কোটি টাকা অগ্রিম? বাম আমলের ওই কর্তার দাবি, মূলত খরা, বন্যা, বিপর্যয় এবং নির্বাচনের সময়েই জেলাশাসক এবং এসপি-রা অগ্রিম তুলেছেন। অগ্রিম নেওয়ার তালিকায় শীর্ষে থাকা স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানান, নির্বাচনের কাজকর্ম এবং পুলিশের রসদ জোগাতে অনেক টাকা অগ্রিম তোলা হয়েছে। নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরে পুলিশ মোতায়েন, জঙ্গলমহলে পুলিশি অভিযান ও পুলিশ ক্যাম্প, বিভিন্ন সময়ে গোলা-বারুদ কেনা হয়েছে অগ্রিমের টাকায়। গত বিধানসভা এবং লোকসভা ভোটের সময় প্রায় ২০০ কোটি টাকা অগ্রিম নিয়েছিল স্বরাষ্ট্র দফতর। জেলাগুলি থেকে সেই টাকা হিসেব পায়নি তারা। আবার বিভিন্ন জেলাপরিষদ প্রায় ১৭০ কোটি টাকার অগ্রিম নিয়ে কোথায়, কী ভাবে খরচ করেছে জানাতে পারেনি। ফলে অর্থসচিবের কাছে সেই হিসেবও দিতে পারেনি পঞ্চায়েত দফতর।
অর্থ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, যে সব প্রকল্প কিংবা খরচের আগাম অনুমোদন থাকে, কোষাগার থেকে সেই টাকা দেওয়াটাই নিয়ম। তবে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, হাসপাতাল-খরচ, অফিসকাছারি পরিষ্কার করার মতো দৈনন্দিন কাজের জন্য যে টাকার প্রয়োজন হয়, আগাম অনুমোদন ছাড়াও কোষাগার সেটা মিটিয়ে দেয়। এর বাইরে বিশেষ প্রয়োজনে কোনও দফতরের অর্থের প্রয়োজন হলে তারা ট্রেজারি থেকে অগ্রিম তুলতে পারে। অগ্রিম নেওয়ার শর্তই হল, ৬০ দিন বা দু’মাসের মধ্যে সেই টাকার হিসেব জমা দিতে বাধ্য থাকবে সংশ্লিষ্ট দফতর। অর্থ দফতরের কর্তারা নিজেরাই জানাচ্ছেন, কঠোর নিয়ন্ত্রণ না থাকার ফলে প্রথম বারের অগ্রিমের হিসেব না দিয়েও ফের অগ্রিম তুলছে বিভিন্ন দফতর। এ ভাবেই জমছে হিসেব-ছাড়া টাকার পাহাড়। |