হিন্দু আচার রক্ষায় তিনি ছিলেন ট্রাফিক পুলিশ
বার বার অসাবধান প্রয়োগে ‘যুগাবসান’ শব্দটি ইদানীং গুরুত্ব হারিয়েছে, না হলে বলা যেত, মুরারিমোহনের দেহাবসানে যুগাবসান হল। তিনি বলতেন, সব ধর্মে এবং সব সমাজে নিয়ম-কানুনের ট্রাফিক পুলিশ থাকে, আমাদের সনাতন ধর্ম ছাড়া। আচার-বিচার ও নিয়মের নৈরাজ্যের সুযোগে এক সময় কেউ কেউ এই সমাজকে অকারণে নিপীড়িত করেছে হয়তো। কিন্তু, এখন তার উল্টো। একমাত্র আমাদেরই নিজের আচরিত ধর্মের কিছু জানতে হয় না। এর ফলে ভ্রমাত্মক আচরণে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।
আমাদের সময় যে সামান্য কয়েক জন লোক বিপুল নিষ্ঠায় এবং তুলনাহীন ত্যাগ করে শাস্ত্রীয় ধারাগুলিকে প্রাণবন্ত রাখার চেষ্টা চালিয়েছিলেন, মুরারিমোহন তাঁদের অন্যতম। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কিছু বছর আগে বাবার সঙ্গে যখন বনগ্রাম থেকে হাওড়ার খুরুট রোডের কাছে চলে এলাম তখন মুরারিদার পিতৃদেবের নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বলে যথেষ্ট নাম। কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের টোলটি ছিল আমাদের বাড়ির খুব কাছে। সেই বাড়ির এক বাসিন্দা দেবীচরণ খাঁ পরে ম্যাট্রিকে প্রথম হয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল। মুরারিমোহন আমার থেকে বেশ কয়েক বছরের বড়। কিন্তু, বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনে তাঁর ভাইরা পড়তেন। সেই সূত্রে গোপাল ব্যানার্জি লেনে ওদের বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল।
মুরারিদা পড়তেন শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ে। ওঁদের পরিবারের সঙ্গে বিখ্যাত ইংরেজ প্রতিষ্ঠান বার্ড হাইলজার্সের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। সেই ছোটবেলাতেই শুনতাম, বিখ্যাত বেনথল সাহেব এবং তাঁর ভাই এই পরিবারের পাণ্ডিত্যের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সেই সূত্রে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের অনেকেই বার্ড হাইলজার্সে কাজ করতেন।
মুরারিদা সম্বন্ধে কিন্তু অন্য কথা শুনতাম, সাহেব বাড়ির করণিক না হয়ে তিনি শাস্ত্রপাঠে ডুবে গেলেন এবং বহু বছর ধরে অসংখ্যা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের গর্ব হয়ে উঠলেন। বড় বড় ডাইরেক্টরি পঞ্জিকার নতুন সংস্করণ এলে প্রথমেই যে নামটিতে বিস্মিত হতাম তা, মহামহোপাধ্যায় শ্রীমুরারিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বেদান্তাদিতীর্থ শাস্ত্রী, তান্ত্রিকাচার্য।
সেই সময় হাওড়া ছিল সংস্কৃতচর্চার বড় কেন্দ্র। আমাদের বাড়ির কয়েক পা দূরেই ছিল পণ্ডিত রামগোপাল ন্যায়রত্নের টোল। তাঁর পুত্র নিত্যানন্দেরও ভারতজোড়া খ্যাতি। মুরারিমোহন যথাসময়ে তাঁর বংশের খ্যাতিকে বহুবিস্তৃত করেছিলেন। স্থানীয় ব্যক্তিরা সবাই জানত, বার্ড হাইলজার্সের কর্ণধারেরা এক সময় তাঁকে ‘রিলিজিয়াস অ্যাডভাইসার’-এর দুর্লভ সম্মান দিয়েছিলেন। খুরুট রোডে মুরারিদার টোলের সামনেই বসত আমাদের আড্ডা। এবং কলকাতা শহরের খ্যাতনামা ব্যক্তিদের তাঁর কাছে এসে বিধান নিতে দেখা যেত।
বিশিষ্টদের এই তালিকায় উত্তমকুমার থেকে কে না থাকতেন! শোনা যায়, ওঁকে দিয়ে লক্ষ্মীপুজো করানোর জন্য উত্তমকুমার ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে এই অনিচ্ছুক পণ্ডিতকে কয়েক বার বাড়ি নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন মহানায়ক। দূর থেকেও অনেক কোষ্ঠীবিচারের অনুরোধ আসত, এই তালিকায় অমিতাভ বচ্চন ও তাঁর পরিবারের নামও শুনতে পাবেন আমাদের পুরনো পাড়ায়।
কিন্তু কোষ্ঠীবিচার ইত্যাদি ছিল মুরারিদার জীবনের ছোট্ট একটি অংশ। প্রাচীন ভারতে হিন্দুদের পূজাপদ্ধতি, আচার-বিচার সম্বন্ধে ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। এই জ্ঞান যাতে সম্পূর্ণ লুপ্ত না হয়ে যায় তার জন্য ছিল আজীবন প্রচেষ্টা। এ বিষয়ে সারা জীবন ধরে অনেক প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন। ওঁকে বলতে শুনেছিলাম, ধর্মীয় আচারের গ্রামার না জেনে রাখাটা কোনও গর্বের কথা নয়।
স্বামী বিবেকানন্দের পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত ‘শিষ্টাচার পদ্ধতি’ নামে একখানি বই লিখেছিলেন, যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে মুরারিদা বলেছিলেন, বইটা পেলে আমাকে দেখিও। বলেছিলাম, আপনি বিলেতের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো হয়েছেন, আমাদের উচিত আপনাকে দিয়ে হিন্দুইজম-এর নিউ হ্যান্ডবুকটা লিখিয়ে নেওয়া। তিনি বলেছিলেন, হ্যান্ডবুক নয়, ঠিকমতো সংকলন করলে এনসাইক্লোপেডিয়া হয়ে যাবে। এক বার টেলিফোনে মুরারিদাকে চান্দ্রায়ণ ব্রত সম্পর্কে জিগ্যেস করেছিলাম। মুহূর্ত না ভেবে বললেন, চার রকম চান্দ্রায়ণের মধ্যে কার কথা বলছ? তুমি প্রথমে পিপীলিকা-মধ্য চান্দ্রায়ণের লক্ষণগুলো লিখে নাও।
বাংলা মতে মুরারিমোহন দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন, প্রাণান্তকর পরিশ্রম সত্ত্বেও আট দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি জ্ঞানচর্চা করেছেন, তবু মনে হয়, জ্ঞানের জাহাজটি তাঁর অমূল্য সম্পদগুলি অনাগত কালের জন্য রক্ষা না করেই সমুদ্রগর্ভে বিলীন হলেন। নববর্ষের প্রথম দিনে হাওড়া বাঁশতলা ঘাটে তাঁর শেষকৃত্য হল সেখানেও কিন্তু নিষ্ঠাবান সাধকের সুচিন্তিত নির্দেশ ছিল। তাই বৈদ্যুতিক চুল্লির ব্যবহার না করে হাজার হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় কাঠের আগুনে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হল।

প্রয়াত হলেন মুরারিমোহন
‘আচারের মরুবালুরাশি’কে সজীব করে তুলেছিলেন তিনি, নিজের জীবনে। শুধু পুথির পাতায় নয়, ‘হিন্দুয়ানি’ জড়িয়ে ছিল তাঁর দৈনন্দিনে। সেই দিনযাপন থেমে গেল সোমবার গভীর রাতে। ৯২ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন পণ্ডিত মুরারিমোহন বেদান্তাদিতীর্থ শাস্ত্রী। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গেই এক জন সদস্য কমল সেই লুপ্তপ্রায় বাঙালিশ্রেণির, বিশ্বাস আর জীবনাচরণে যার কোনও ফারাক ছিল না। বারাণসী-সমতুল গঙ্গার পশ্চিমকূলে জন্ম তাঁর। পাঁচশো বছরেরও বেশি পুরনো সেই হাওড়ার সংস্কৃত শিক্ষার ঐতিহ্য নিয়ে তাঁর গর্বের শেষ ছিল না। মজা করে বলতেন, ‘আমরা পশ্চিমী, তাই সূর্য-মুখী। পশ্চিমে তীর বলে গঙ্গায় স্নান করতে গেলে আমরা পূর্বমুখী অর্থাৎ সূর্যমুখী হই, গঙ্গাস্নানের সেটাই রীতি। কলকাতার লোকেরা তা পারেন না, তাই পিছন ফিরে স্নান করতে হয়।’ জীবনের সর্বক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মের আচার-বিচার, রীতিনিয়ম একনিষ্ঠ ভাবে মেনে চলতেন মুরারিমোহন। সংস্কৃতের প্রথাগত শিক্ষাকে টিকিয়ে রাখার জন্য আজীবন লড়াই করেছেন। হাওড়ার আন্দুল, মাজু, উদয়নারায়ণপুর, আমতা ও শিবপুরে ন্যায়চর্চার যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল মুরারিমোহন ছিলেন তার শেষ প্রতিনিধি। পাশাপাশি ছিল জ্যোতিষচর্চা। নিয়মিত বসতেন তাঁর জ্যোতিষকেন্দ্রে। সংস্কৃত শিক্ষায় সরকারকে উদ্যোগী হতে চাপ দিয়েছেন, সংস্কৃত ভাষার সজীব চর্চার জন্য ‘হাওড়া পণ্ডিত সমাজ’-এর ব্যানারে সংস্কৃত নাটক অভিনয়ে উৎসাহ দিয়েছেন। ১৯১৫-য় তাঁর জন্মের বছর ছয়েক আগে এই সংস্থার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর বাবা পণ্ডিত কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতিরত্ন। পিতার প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থার সঙ্গে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জড়িয়েছিলেন তিনি। নামের সঙ্গে উপাধি, নানা সংস্কৃতশিক্ষণ সংস্থার সাম্মানিক পদ, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার-সহ বিবিধ স্বীকৃতি পেয়েছেন মুরারিমোহন। কিন্তু সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি বোধহয় ছিল মানুষের মনে তাঁর ‘সনাতন’ আসনটি। সময়ের শত পরিবর্তনেও যা অপরিবর্তনীয়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.