|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
প্রীতির মতোই মূল্যবান প্রতিশোধস্পৃহা |
প্রহারের মধ্যে যে প্রতিবাদ, যে দণ্ড— তা দিয়ে আত্মসম্মান পুনরুদ্ধারের প্রয়াস, একে গুরুত্ব দিতেই হবে।
ক্ষমা ও অহিংসা পরম ধর্ম, কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা নয়, বর্মা কমিশন নিশ্চয়ই তা ভেবে দেখবেন। লিখছেন
তিলোত্তমা মজুমদার |
আপনার পরিবারে কেউ ধর্ষিত হয়েছেন কি? আপনার শিশুকন্যা, বালকপুত্র, তরুণী বোন, স্ত্রী, এমনকী প্রৌঢ়া মা? যদি না হয়ে থাকেন তো ধর্ষক বিষয়ে আপনার মানবিক সহানুভূতি থাকা দোষের কিছু নয়। এমনকী, ধর্ষক আসলে এই স্বার্থপর নিষ্ঠুর সমাজের উৎপাদন, অতএব তার মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য নয় এ কথা বললেও আপনার আচরণ শিষ্টাচারসম্মত থাকে। বরং, খুব দুঃখের সঙ্গে ধর্ষিতার মৃত্যুকামনা করাই আপনার হৃদয়ের ব্যাপ্তি প্রমাণ করে। কারণ, আপনি তো জানেন, ধর্ষিতাকে এ সমাজ, পরিজন, এমনকী সে নিজে কী চোখে দেখে। অনেকেই তাই বলেন, ধর্ষিতার বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভাল। এই প্রার্থনা মেয়েটির প্রতি সহমর্মিতায় ব্যথাভারাতুর, কিন্তু এর মধ্যেও সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিহিত: একটি মেয়ের স্বাধীন ও সহজ জীবনযাপনের অন্যতম শর্ত— তার শরীরটিকে কীটদংশন থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এই মৃত্যুকামনার চেয়ে কঠিনতর সেই সহমর্মী ভাষ্য— তুমি লজ্জা পেয়ো না। এখানে তোমার কোনও অপরাধ নেই।
দিল্লির মেয়েটির আয়ুষ্কামনায় বিশাল মোমবাতি মিছিল তাই এক সামাজিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। আর তা অবশ্যম্ভাবী। ভারতীয় সমাজ এখন আর সম্পূর্ণভাবে পুরুষতন্ত্র ও তার ধ্বজাধারীর কবলে নেই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষকে লিঙ্গপরিচয়ের ঊর্ধ্বে দেখার চোখ নিঃসন্দেহে তৈরি হচ্ছে। যদিও, নারীকে হেয় করে দেখে যে সমাজ, তার ব্যাপকতার তুলনায় এই দৃষ্টিভঙ্গি অতি ক্ষুদ্রপরিসর। এখনও আমাদের দেশে এবং আরও অনেক দেশেই নির্যাতিত বা ধর্ষিত মেয়েই শাস্তি ভোগ করে বেশি। ভারতে ধর্ষিতাকে শাস্তি দেওয়ার আইন নেই কিন্তু রেওয়াজ আছে। একটি মেয়ে তার পেশাগত ক্ষেত্রে সাফল্যের শিখরে পৌঁছলেও যে সমাজ মনে করে, যোগ্যতায় নয়, আসলে মেয়েটি তার শরীর ব্যবহার করেছে বলেই সফল, সে সমাজ তো ধর্ষিতাকে বলবেই, মরো, বলবেই— তুলসীপাতায় কুকুর প্রস্রাব করলেও পূজায় লাগে কিন্তু একটি মেয়ে ধর্ষকের বিকৃতকামনায় অসহায় শিকার হলেও স্বাভাবিক জীবনের কাবিল থাকে না। ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধ ধর্ষকের; দোষ, পাপ, অন্যায়, অনৈতিকতা ধর্ষকের; এই জরুরি কথাটি তার পরিপার্শ্বে সোচ্চার হয় না বলে ধর্ষিত মেয়ে প্রায়শই অবসাদগ্রস্ত হয়, জীবনকে অর্থহীন ভাবতে থাকে ও আত্মহননাভিমুখী হয়। |
|
ধর্ষকের শাস্তি কী বা কত দূর হওয়া উচিত, তা নিয়ে বর্মা কমিশন যখন কাজ করবেন, এই সমস্ত বিষয় নিশ্চয়ই বিবেচনা করবেন তাঁরা। বিবেচনা করবেন ধর্ষিতার প্রতি সমাজের বিবিধ বিচিত্র মনোভাব। ধর্ষকের মনোভাব বা চিত্তশুদ্ধি ও সংশোধন সম্ভব কি না তাও নিশ্চয়ই হবে আলোচ্য বিষয়। সেই সঙ্গে, একটি মেয়ে শুধু কিছু মাংস ও যৌনগ্রন্থির পুঁটুলি এই মনোভাবের উৎস কোথায়; এটা কি প্রাকৃতিক নিয়ম যে পুরুষ নারী দেখলেই সঙ্গমেচ্ছু হবে বা নারীর সম্মতির পরোয়া করবে না; না কি তা একেবারেই প্রকৃতিবিরুদ্ধ সামাজিক আরোপ পরিবেশ দূষণের মতোই ভোগাকাঙ্ক্ষী মানুষের দূষিত চিত্তের অভিক্ষেপ যারা আদৌ কোনও শিষ্টাচার বা সম্মতির পরোয়া করে না যত ক্ষণ না নিজে ভয় পায়, এই মহা গুরুত্বপূর্ণ মানসিক বিশ্লেষণও গুরুত্ব পাবে। তাঁরা নিশ্চয়ই গুরু অভিনিবেশে ধর্ষকের শাস্তি সম্পর্কে ধর্ষিত নারী এবং তাঁর পরিবার-পরিজনের অভিমত বিশ্লেষণ করবেন। কারণ, ধর্ষণ এমনই এক মর্মবিদারী অপমানজনক এবং অপরিমেয় পীড়াদায়ক ঘটনা, এমনই সুদূরপ্রসারী তার পরিণাম যে, যাঁরা সেই পরিণাম কাছ থেকে দেখেননি, ধর্ষকের প্রতি তাঁদের ক্রোধ, ঘৃণা, প্রতিশোধস্পৃহা কখনও তাঁদের সমান হবে না যাঁরা সেই দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। স্নেহ প্রেম প্রীতির মতো ক্রোধ ঘৃণা প্রতিশোধকামনাও মানবচরিত্রের অনস্বীকার্য দিক। এই সমস্তগুলির নিরপেক্ষ কোনও আদর্শ দণ্ডদাতার ভূমিকা পালন করতে গেলেও, সাধারণ মানুষের মনোভাব কখনওই উপেক্ষণীয় নয়। প্রতিশোধস্পৃহা নিশ্চয়ই বাঞ্ছনীয় নয়, কিন্তু যে নির্যাতিত, তার কাছে কতখানি ক্ষমাশীলতা সমাজ আশা করতে পারে? পথে-ঘাটে চলাফেরাকালীন বিকৃত পুরুষের নোংরা ইঙ্গিত বা ছুঁয়ে দেওয়ার মালিন্য প্রায় মললিপ্ত হওয়ার মতো ঘৃণা সঞ্চার করে, তীব্র ক্রোধ জাগায়, অপমানের সঙ্গে অসহায়তার গা রি-রি করা ভাব মনে লেগে থাকে দিনের পর দিন। লোকটাকে ধরতে পারলে চড়-থাপ্পড় কষিয়ে কিছুটা ঝাল মেটানো যায়। না পারলে আরও অসহায়তা। দণ্ডবিধানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অনুভূতি। এই প্রহারের ইচ্ছা। প্রহারের মধ্যে যে প্রতিবাদ, যে দণ্ড তা দিয়ে আত্মসম্মান পুনরুদ্ধারের প্রয়াস, একে গুরুত্ব দিতেই হবে। ক্ষমা ও অহিংসা পরম ধর্ম, কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা নয়, আশা করি বর্মা কমিশন তা ভেবে দেখবেন।
শুধু ক্ষোভ বা বলদর্প বা হিংসার প্রকাশ নয়; মেয়েরা যৌনতা ও সন্তানজন্মের যন্ত্র— এমন ধারণার উৎস নারীর গৃহসম্বল জীবনচর্চিত সমাজ। যে জীবনে নারীর বুদ্ধি, ক্ষমতা এবং স্বাধীনতার স্ফুরণ দর্শাবার সুযোগ প্রায় নেই। সেই সঙ্গে, মা-বোন ছাড়াও যে একটি মেয়ের সঙ্গে সপ্রীত সসম্মান সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব, দক্ষতা ও মেধায় মেয়ে আর ছেলেতে কোনও তফাত নেই— এই বোধ স্কুলে কলেজে ব্যাপ্ত হওয়ার পথ রুদ্ধ কারণ চেতনা সঞ্চারের সঙ্গে সঙ্গে একটি মেয়ে ও একটি ছেলে যথাক্রমে গার্লস ও বয়েজ স্কুলে পড়তে যায় বেশির ভাগ। লিঙ্গ সচেতনতার সেই প্রথম পাঠ। ভুল পাঠ। বুঝতে হবে, নারীকে মাথায় তুলে নিও না, পায়ের তলায় রেখো না, রাখো পাশে। শেখো, জানো, বোঝো— একটি মেয়েও তোমার মতো মানুষ, সে সব পারে। এই সংবেদনশীল বোধ কত জরুরি, শাস্তি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাও নিশ্চয় বিবেচনা করবেন কমিশন।
এক দল বলছেন, নিগ্রহকারীদের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন, তাই কঠোর শাস্তি নয়, মনের সংশোধনই প্রকৃত পন্থা। সাধু প্রস্তাব। কিন্তু এই দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের রূপায়ণ হওয়ার মধ্যবর্তী লম্বা সময়ে কী হবে? ধর্ষণ চলতে থাকবে এবং গুরুতর দণ্ড না পেয়ে ধর্ষকও দিব্য বেঁচে থাকবে? আর এক দল ভাবছেন, ধর্ষকের প্রাণদণ্ড আইনসিদ্ধ হলে সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপ করার জন্য ধর্ষক ধর্ষণের পর খুন করবে। যেন ধর্ষণের পর খুন হয় না। যেন বাসে মেয়েটিকে বাঁচিয়ে রাখতেই চেয়েছিল লোকগুলো। যেন কোনও কোনও ধর্ষক যে কর্মটি করে প্রাণে মারে না, তা ধর্ষিতা সুস্থ-সবল হয়ে তার বিরুদ্ধে কোতোয়ালিতে যাতে নালিশ করতে পারে, তার জন্যই। দিল্লির বাসে থাকা লোকগুলির বর্বরতা বিরল এবং চরম। এই বিশ্বের আলো-হাওয়ায় তাদের কেন অধিকার থাকবে? বর্মা কমিশন জনগণের মত নেবেন। নিতে গিয়ে, দেখেছেন, দেখবেন, আমার মতো আরও অগণন সাধারণ মানুষ চান ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। চূড়ান্ত শাস্তি। মারো। হাড় গুঁড়ো করে দাও। গুলি করো। ফাঁসিতে লটকাও। হ্যাঁ। আমরা জানি, ভারত হিংসা চায় না। অহিংসা পরম ধর্ম আমরা শিখেছি। কিন্তু আমরা এও শিখেছি, সম্মান মৃত্যুর চেয়ে বড়। ধর্ষণে এক জন ব্যক্তির যে চরম অপমান অসম্মান, আর কোনও ঘটনাই তার তুল্য নয়। তাই, ধর্ষকের শাস্তি হোক নির্যাতন এবং মৃত্যুদণ্ড। |
|
|
|
|
|