প্রবন্ধ ১...
গুজরাতে উন্নয়ন হয়েছে, এটা ঘটনা
ত কিছু দিন ধরে একটা কথা বার বার বলা হয়েছে গুজরাতে গত এক দশকে আয় বেড়েছে, কিন্তু সেই আয়বৃদ্ধির বণ্টন এতটাই অসম হয়েছে যে, গরিব মানুষ কোনও সুফল পায়নি। অর্থাৎ, বৃদ্ধি হয়েছে, যথার্থ উন্নয়ন হয়নি। ‘গ্রোথ’ সত্য, ‘ডেভেলপমেন্ট’ মিথ্যা। এই অভিযোগ কি সত্য?
প্রথমে সরাসরি দারিদ্রের হিসাব দেখা যাক। দারিদ্রের বিশদ সরকারি পরিসংখ্যান আসে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা থেকে। পাঁচ বছর অন্তর বেশি সংখ্যায় মানুষকে নমুনা হিসাবে নিয়ে সমীক্ষা হয়। ২০০৪-’০৫ সালে এমন ‘লার্জ সাম্পল’ সমীক্ষা হয়েছিল, তাতে গুজরাতে ৩১.৬% মানুষ ছিলেন দারিদ্রসীমার নীচে। পরের সমীক্ষায়, ২০০৯-’১০ সালে দেখা গেল, সেই অনুপাত কমে দাঁড়িয়েছে ২৩%। গ্রাম আর শহরের পরিসংখ্যান আলাদা করে দেখা যাক। ২০০৪-’০৫ সালে গুজরাতের গ্রামে গড়পড়তা দারিদ্রের হার ছিল ৩৯.১%, পাঁচ বছর পরে তা নেমে আসে ২৬.৭ শতাংশে। শহরে দারিদ্র ছিল ২০.১%, হয়েছে ১৭.৯%। রাজ্যে কৃষির উন্নতি হয়েছে দ্রুত গতিতে, ফলে গ্রামীণ দারিদ্র লক্ষণীয় ভাবে কমেছে, শহরে ততটা হয়নি। যদিও মনে রাখতে হবে, শহরে দারিদ্রের হার গ্রামের তুলনায় অনেকটা কম, ফলে সে হার আরও কমানো তুলনায় কঠিন। তার পরেও অবশ্যই এ কথা বলা যায় যে, গুজরাতে দারিদ্র আরও বেশি কমা উচিত ছিল, বিশেষত শহরে। কিন্তু সেটা বলা এক কথা, আর ‘দারিদ্র কমেনি’ বলা আর এক কথা। নিঃসংশয়ে বলা যায়, রাজ্যে দারিদ্র কমেছে। যাঁরা তা মানছেন না, তাঁরা তথ্য-পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কথা বলছেন না।
গুণমুগ্ধ। ‘আইকন টপ’ নামে নরেন্দ্র মোদীর পুতুল হাতে তাঁর ভক্তরা। ডিসেম্বর, ২০১২। ছবি: এ এফ পি
এ বার দেখি অসাম্যের ছবিটা। সাধারণত অসাম্য মাপা হয় ‘জিনি কোয়েফিশিয়েন্ট’ নামক একটি সূচক দিয়ে। সূচকটি এমন ভাবে তৈরি করা হয় যে, তার মান যত বেশি, অসাম্যও তত বেশি। (ষোলো আনা সাম্য থাকলে এই সূচকের মান হয় ০, ষোলো আনা অসাম্য থাকলে ১।) সাধারণত ভোগব্যয়ের অসাম্য হিসাব করা হয়, কারণ আয়ের চেয়ে ভোগব্যয়ের তথ্য বেশি নির্ভরযোগ্য। তো, যোজনা কমিশন জানাচ্ছেন, ২০০৪-’০৫ সালে গোটা ভারতে গ্রামাঞ্চলে গড়পড়তা জিনি-সূচক ছিল ০.২৫, গুজরাতেও ঠিক তা-ই। ওই সময়ে শহরের জিনি-সূচক ছিল ভারতে ০.৩৫, গুজরাতে ০.৩২। ২০০৯-’১০-এর জন্য যোজনা কমিশন জিনি-সূচক মাপেনি। অর্থনীতি-বিশারদ সুরজিৎ ভাল্লা মেপেছেন। তাঁর হিসাবে, গুজরাতে ২০০৯-’১০ সালে জিনি-সূচক ০.৩০। এটুকু অন্তত বলা যায় যে, এই পাঁচ বছরে গুজরাতে অসাম্য বৃদ্ধির কোনও প্রমাণ নেই।
গুজরাতে বৈষম্য এবং অসম উন্নয়নের ধারণার পিছনে হয়তো এই প্রচলিত বিশ্বাসটি কাজ করছে যে, গুজরাতের আর্থিক অগ্রগতি নিতান্তই শিল্পায়নের জোরে, ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট’-এর ভাবমূর্তিতে গ্রাম নেই। ২০০৪-’০৫ সালে গুজরাতের মোট উৎপাদনে (গ্রস স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জি এস ডি পি) শিল্পের (ইন্ডাস্ট্রি) ভাগ ছিল ৩৬.৫%, ২০১০-’১১ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯.৪%। কিন্তু লক্ষ করার ব্যাপার, শিল্প-উৎপাদন (ম্যানুফ্যাকচারিং) অর্থাৎ আমরা সাধারণ ভাবে কলকারখানার শিল্প বলতে যা বুঝি, রাজ্যের মোট উৎপাদনে তার ভাগ একই থেকে গিয়েছে; ২৭.৩% থেকে ২৭.৬%। শিল্পের মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং ছাড়াও অন্য যে ক্ষেত্রগুলিকে ধরা হয়, তাদের কয়েকটি খুব এগিয়ে গিয়েছে, যেমন বিদ্যুৎ, গ্যাস, জল সরবরাহ এবং নির্মাণ। আর একটা কথা বলা দরকার, বড় শিল্পের পাশাপাশি ছোট এবং মাঝারি শিল্পেরও রীতিমতো উন্নতি হয়েছে। রাজ্যে ৩৬৯টি ‘ক্লাস্টার’ বা মণ্ডলীতে ২ লাখ ৩০ হাজার নথিভুক্ত মাঝারি ও ছোট শিল্পসংস্থা আছে। বস্তুত, ছোট সংস্থার নথিভুক্তির মাত্রাও বেড়েছে, কারণ নথিভুক্তির খরচ এবং ঝঞ্ঝাট আগের চেয়ে কমে গিয়েছে। শিল্পের পাশাপাশি, রাজ্যের মোট উৎপাদনে পরিষেবার অনুপাত ৪৪% থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬%। সুতরাং, গুজরাতের আয়বৃদ্ধি কেবল বড় বড় কলকারখানায় ঘটেনি, ঘটেছে পরিকাঠামো ও পরিষেবাতেও।
এবং কৃষিতেও। গুজরাত শিল্পোন্নত রাজ্য হিসাবে পরিচিত। এবং ২০০৪-’০৫ থেকে ২০১০-’১১, এই সময়ে রাজ্যের মোট উৎপাদনে (পশুপালন সহ) কৃষির ভাগ ১৩.২ থেকে ১০.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু, অনুপাত কমলেও, গুজরাতের কৃষি উৎপাদনের লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে, বিশেষত ২০০০ সাল থেকে। ২০০১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কৃষির অগ্রগতি হয়েছে বার্ষিক গড় ১০.৫% হারে। এই গতি, এক কথায়, চমকপ্রদ। এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানত রাস্তা, জল এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের উন্নতির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্যের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে। কৃষিতে নানা ধরনের উদ্ভাবন কাজে লাগানো হয়েছে, বিভিন্ন এন জি ও’র সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়িত হয়েছে। কৃষকদের গোষ্ঠীকে ট্রাক্টর কিনতে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, যে ট্রাক্টর তাঁরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করেন। বিশেষ ধরনের জাল ব্যবহার করে ফসলকে পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচানো হয়েছে। সেচের জন্য জলের ব্যবহারেও উন্নতি ঘটানো হয়েছে। পাশাপাশি কৃষিপণ্য বাজারে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাটিতে উন্নতি সাধিত হয়েছে। কৃষির এই সার্বিক অগ্রগতির ফলে গ্রামীণ দারিদ্র না কমলেই আশ্চর্য হতে হবে।
এ বার আসা যাক ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’ বা মানব উন্নয়নের পরিসংখ্যানে। গুজরাতে মানব উন্নয়নের নানা সূচক নিয়ে যে সব আলোচনা হচ্ছে, তাতে অনেক সময়েই একটা কথা খেয়াল করা হচ্ছে না। ভারতে ২০১১ সালের মানব উন্নয়ন রিপোর্টে যে সব তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে, তার অনেকগুলি পুরনো, ২০০৪-’০৫-এর তথ্য। গুজরাতে এখন যে দ্রুত আয়বৃদ্ধির পর্ব চলছে, সেটির শুরু ২০০২ থেকে। তা ছাড়া, গুজরাতে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক ক্ষেত্রগুলির উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়েছে ২০০৭ সাল থেকে, তার আগে নয়। আগেই জোর দেওয়া উচিত ছিল, সে বিষয়ে কোনও তর্ক থাকতে পারে না। কিন্তু তার পরেও কয়েক বছর কেটে গিয়েছে। সুতরাং আয়বৃদ্ধির সুফল কত দূরে পৌঁছল, কতটা পৌঁছল, তার যথাযথ হিসাব কষার জন্য সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান দেখা জরুরি। এখনও পর্যন্ত সাম্প্রতিক মানব উন্নয়নের সূচকগুলি পাওয়া যায়নি। তার জন্য অপেক্ষা করাই ভাল, তার বদলে পুরনো তথ্য দিয়ে কাজ চালাতে গেলে ভুল সিদ্ধান্তের, অন্যায় সিদ্ধান্তের ভয় থাকে।
সামাজিক ক্ষেত্রের যেগুলি সম্পর্কে তুলনায় সাম্প্রতিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, বরং সেগুলি দেখা যেতে পারে। যেমন, শিক্ষা। মাধ্যমিক স্তরে ‘ড্রপআউট’ বা স্কুল-ছুট পড়ুয়ার অনুপাত ২০০০-’০১ সালে ছিল ২৮.১১%, ২০১১-’১২ সালে হয়েছে ২৩.৭৭%। তফসিলি জাতির (এস সি) ক্ষেত্রে অনুপাতটি কমেছে ৩৩.৪২ থেকে ২৫.০৬ শতাংশে, তফসিলি জনজাতির (এস টি) ক্ষেত্রে ৩১.২৫ থেকে ২৬.৬৩। কালক্রমে শিক্ষার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অনুপাত কী ভাবে পালটেছে, তা জানার জন্য বিভিন্ন নথি দেখা যেতে পারে। যেমন, ‘প্রথম’ নামক এন জি ও’টি গ্রামীণ ভারতের শিক্ষা পরিস্থিতির যে বার্ষিক রিপোর্ট (এ এস ই আর) প্রকাশ করে, কিংবা শিক্ষা পরিকল্পনা ও প্রশাসনের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য কাঠামোর (ডি আই এস ই) যে পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়, তা খতিয়ে দেখলে জানা যাবে, গুজরাতে ক্লাসঘর পিছু পড়ুয়ার সংখ্যা কমেছে, কমেছে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত, মাত্র এক জন শিক্ষকবিশিষ্ট স্কুলের সংখ্যা কমেছে, স্কুলের পরিকাঠামো উন্নত হয়েছে। নিশ্চয়ই বলা যায় যে, আরও উন্নতি হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু কোনও উন্নতি হয়নি, এটা কী করে বলা যাবে?
এ বার স্বাস্থ্য। রাজ্যে শিশুমৃত্যুর হার ২০১০’এ নেমে এসেছে হাজার প্রতি ৪৪-এ। বাড়িতে সন্তান প্রসবের অনুপাত অনেক কমেছে, হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসবের অনুপাত ’০৩-০৪-এর ৫৫.৮৭% থেকে বেড়ে ’১১-১২’য় দাঁড়িয়েছে ৯৩.৫%। দ্রুত বেড়েছে শিশুদের প্রতিষেধক দেওয়ার মাত্রাও। এ সব থেকে শিশুর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রত্যক্ষ হিসাবের জন্য কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে। এখন শিশুদের অপুষ্টির যে সব পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, খোঁজ করলে দেখবেন সেগুলি পুরনো তথ্য, খুব বেশি হলে ২০০৫-’০৬-এর। গরিবের ভোগব্যয় সংক্রান্ত প্রচলিত তথ্যগুলি দেখলেও আগে জেনে নেওয়া ভাল, সেগুলি কত বছর আগেকার। আর, মানুষ খাবারদাবারের উপর কত খরচ করছেন, শুধু সেটুকু দেখা ঠিক নয়, আয় যখন বাড়ে তখন তাঁরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে খরচ বাড়ান, কিছু টাকা জমিয়ে মাথা গোঁজার জায়গা তৈরি করেন। সব মিলিয়ে বিচার করা দরকার, সে জন্য যথেষ্ট তথ্য জরুরি।
সামাজিক উন্নয়নে গুজরাত, বিশেষ করে উত্তর গুজরাত এখনও বেশ পিছিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হল, অগ্রগতি হয়েছে কি হয়নি। তথ্য পরিসংখ্যান বলছে, হয়েছে। রাস্তা, বিদ্যুৎ, জল, স্কুল, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নানা ক্ষেত্রে গরিব মানুষের সুযোগ বেড়েছে। ফলে তাঁদের জীবনযাত্রার মান কিছুটা উন্নত হয়েছে। এমনকী সৌরাষ্ট্র, কচ্ছ বা ডাংস-এর মতো অনগ্রসর এলাকাতেও। উত্তর গুজরাতের ছবিটা নিশ্চয়ই অনেকখানি আলাদা, ভোটের অঙ্কেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু সামগ্রিক ছবিটা বদলাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। ২০০৭-এর পরে সামাজিক উন্নয়নে যে জোর পড়েছে, ২০০২-এ সেটা ছিল না। আমি মনে করি, ২০১৩’য় উত্তর গুজরাতেও নজর দেওয়া হবে।

অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ সংযুক্ত। ‘গুজরাট: গভর্নান্স ফর গ্রোথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’
(অ্যাকাডেমিক ফাউন্ডেশন) গ্রন্থের লেখক। মতামত ব্যক্তিগত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.