দুর্ঘটনা, চোরাশিকার, চোরাচালান, বধক্রীড়া: নানা মত নানা পথের মধ্যে একটি সার সত্য স্পষ্ট। কেবল নিজ প্রজাতির প্রতি হিংসার নিরিখে নহে, বন্য পশুর প্রতি হিংসার বীভৎস প্রকাশেও ২০১২ সালে বিশ্বদরবারে দৃষ্টান্ত গড়িতে সমর্থ হইয়াছে ভারত। অন্যান্য দেশে পরিবেশ ও প্রাণিজগৎ বিষয়ে সচেতনতা যতই বাড়িতেছে, এই দেশে যেন ততই তাহা তলানিতে পৌঁছাইতেছে। হাতি, গণ্ডার, বাঘ, কাহারও নিস্তার নাই। শৃঙ্গবিশিষ্ট গণ্ডারের ন্যায় আক্রান্ত প্রজাতি দ্রুত বিপন্ন প্রজাতিতে পরিণত হইবার অভিমুখে ছুটিতেছে, বাঘের মতো বিপন্ন প্রজাতি দ্রুত অবলুপ্তির পথে আগাইতেছে। সভা সমিতি রাজনীতি সমস্ত ব্যর্থ প্রমাণিত, ১৯৬০ সালের বন্যপশু নির্যাতন রোধক আইন অপর্যাপ্ত বলিয়া ২০১১ সালে যে ড্রাফট অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাক্ট প্রস্তাবিত, তাহাও যথেষ্ট নহে বলিয়া সমালোচিত। অসমের কাজিরাঙা সংরক্ষিত অঞ্চলের দৌলতে গত বারো মাসে বারোটি গণ্ডার মারা পড়িয়াছে কেবল চোরাশিকারে। হাতির পরিসংখ্যানে দেখা যাইবে, অসমে বৎসরের শেষ দুই মাসে ১০টি হাতি নিহত, আর ওড়িশায় বৎসর জুড়িয়া মারা পড়িয়াছে ১৭টি হাতি।
হত্যার পাশাপাশি যে অবিরাম দুর্ঘটনার প্রবাহ, তাহাকেও হত্যা বলিলে অত্যুক্তি হয় না। ট্রেনে কাটা পড়িয়া কিংবা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হইয়া রেললাইনের নিকটবর্তী অঞ্চলে হাতির মৃত্যু ওড়িশায় একটি সাধারণ ঘটনায় পর্যবসিত। বৎসরের শেষ দিনও চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ধাক্কায় পর পর ছয়টি হাতি কাটা পড়িল। নিছক দুর্ঘটনা বলিয়া এমন ঘটনাকে হেয় করা যায় না। দুর্ঘটনা শুধু দুর্ঘটনা নহে, তাহার পিছনে বহু ক্ষেত্রেই থাকে অন্যায় অবজ্ঞা, পরিকল্পনা ও প্রয়োগক্ষমতার চূড়ান্ত অভাব, সংবেদনশীলতার অসহ স্খলন। যে দুর্ঘটনা অহরহ ঘটে, কেন তাহা আটকাইবার জন্য যথেষ্ট প্রতিরোধক ব্যবস্থা লওয়া যায় না, জঙ্গলের পার্শ্ববর্তী রেললাইনগুলিতে বন্য পশুর অবাধ যাতায়াত আটকাইবার জন্য অতিরিক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না, তাহা বোধগ্রাহ্য নহে। এই অপরিকল্পিত অবহেলা পরিকল্পিত হত্যা হইতে কোনও অংশে ন্যূন নহে। আসলে, আইন রহিয়াছে আইনের স্থলে, বাস্তবে তাহার প্রয়োগ কিংবা প্রতিফলনের চিহ্ন নাই। বাস্তবিক, ভারতে বন্যপশু সংরক্ষণের জন্য কোনও অতিরিক্ত আইন প্রণয়নের আর প্রয়োজন নাই, যাহা আছে তাহাই যথেষ্ট। গণ্ডারের শৃঙ্গ লোভনীয় পাচার-দ্রব্য, তাই নিয়মিত গণ্ডারহত্যাচক্র কার্যকর থাকে: এই চক্র আটকাইবার জন্য পশুহিংসা-নিবারক বিশেষ আইন কী দরকার, পাচার-বিরোধী আইনের উপযুক্ত প্রয়োগই তো যথেষ্ট। এ দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ধরনটি হইল, প্রথমেই ‘আরও আইন চাই’ মর্মে বজ্রহুঙ্কার। সমস্যা অন্যত্র। আইনের কাজ আইন করিয়াছে, এ বার প্রশাসনের কাজ করুক প্রশাসন, এবং বিচারের কাজ হউক সম্যক গুরুত্বে। হিংসাত্মক কার্যকলাপ আটকাইবার মানসিকতা সত্যই থাকিলে সে কাজ অবশ্য হইবে, কী মনুষ্যজগতের ক্ষেত্রে, কী প্রাণিজগতের ক্ষেত্রে। মানসিকতাটি অর্জন করা যাইবে কি না, তাহাই আসল প্রশ্ন। |