গুরু পাপে লঘু দণ্ড হইলে সেই শাস্তি তাহার মূল ধর্ম হইতে বিচ্যুত হয়। শাস্তি শুধুমাত্র অতীতের ভুলের মাশুল নহে, তাহা ভবিষ্যতের অপরাধ রোধ করিবার একটি পন্থা। বস্তুত, তাহার ভবিষ্যৎমুখী চরিত্রটিই প্রধান। অর্থাৎ, আজ কোনও অপরাধী যে শাস্তি পাইতেছে, সেই শাস্তির আশঙ্কা এই বিশেষ অপরাধীকে তো বটেই, অন্যদেরও ভবিষ্যতে এই অপরাধ করিতে বাধা দিবে। অতএব, গুরু পাপে যদি লঘু দণ্ডের বিধান হয়, তাহা একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত তৈরি করিবে অপরাধীরা প্রত্যাশা করিবে, অপরাধের মাপের তুলনায় শাস্তি তেমন হইবে না। অর্থনীতির মামুলি লাভ-লোকসানের সমীকরণ লঘু দণ্ড সর্বদাই অপরাধের লাভের দিকে পাল্লা ঝুঁকাইয়া রাখিবে। ভবিষ্যতের প্রত্যাশাই বর্তমানের আচরণ স্থির করিয়া দেয়। অতএব, বিচারব্যবস্থা যদি কোনও একটি বিশেষ ক্ষেত্রে অপরাধের গুরুত্বের তুলনায় লঘু দণ্ডের বিধান দেয় তবে ভবিষ্যতে সেই অপরাধের প্রবণতা নিশ্চিত ভাবেই বাড়িবে। এই কারণেই অপরাধ এবং শাস্তির গুরুত্বের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা জরুরি। প্রশ্নটি প্রতিশোধের নহে, প্রশ্ন ভবিষ্যতে অপরাধের সম্ভাবনা কমাইয়া আনিবার। এই অবস্থায় লঘু দণ্ডের বিলাসিতা করিবার কোনও অধিকার কর্তৃপক্ষের থাকে না।
অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন এইখানেই তাহার কর্তব্য হইতে চ্যুত হইল। তাহারা মোহনবাগানকে দুই বৎসরের জন্য আই লিগ হইতে বহিষ্কার করিয়াছে। ইহাকে ‘লঘু দণ্ড’ বলিলেও কম বলা হয় ইহা শাসনের নামে তামাশা। মোহনবাগানের অপরাধ অভ্রংলিহ। তাহারা খেলার ধর্ম হইতে বিচ্যুত হইয়াছিল। খেলিতে নামিয়া মাঝপথে পলায়ন করা খেলোয়াড়ের কাজ নহে। মোহনবাগানের এই আচরণে ফুটবলের সম্মানহানি হইয়াছে। দলীয় কর্তাদের দাবি, আরও একটি ১৬ অগস্ট যাহাতে না ঘটে, তাঁহারা তাই দল তুলিয়া লইয়াছিলেন। ইহা অজুহাত। মাঠে গোলমাল বাধিবার পরেও দল খেলিয়াছে। বিরতির সময় এমন কী ঘটিল যে তাহার পর মোহনবাগান আর মাঠে নামিল না? অনুমান করা চলে, একের পর এক খেলায় হারিতে হারিতে ক্ষুব্ধ সমর্থকরা চিরশত্রু ইস্টবেঙ্গলের নিকট হারে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া জানাইতে পারেন, এই আশঙ্কাতেই মোহনবাগান মাঝপথে খেলা ছাড়ে। এহেন অখেলোয়াড়োচিত আচরণ ক্ষমার অযোগ্য। যাহারা খেলা অপেক্ষা জয়-পরাজয়কেই অধিক গুরুত্ব দেয়, তাহারা খেলিবার অযোগ্য। একই সঙ্গে উল্লেখ্য, মোহনবাগানের আচরণ শুধু অনৈতিক নহে, বে-আইনিও বটে। আই লিগে মাঝপথে খেলা ছাড়িয়া পলায়ন করা গুরুতর অপরাধ হিসাবে স্বীকৃত। কাজেই, নৈতিকতার সীমা লঙ্ঘনের জন্য যদি শাস্তি না হয়, আইনের গণ্ডি অতিক্রম করিবার জন্যই মোহনবাগানের কঠোর শাস্তি হওয়া বিধেয় ছিল। শুধুমাত্র আই লিগ হইতে মাত্র দুই বৎসরের জন্য বহিষ্কার কোনও শাস্তিই নহে। মোহনবাগানের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বিধেয় ছিল। দেশের কোনও প্রতিযোগিতাতেই যাহাতে দলটি অংশগ্রহণ না করিতে পারে, তাহা নিশ্চিত করা ফেডারেশনের কর্তব্য ছিল। বিপুল অঙ্কের জরিমানাও করা উচিত ছিল। মোহনবাগানের শাস্তি যাহাতে অন্য সব দলের নিকট দৃষ্টান্ত হইয়া থাকে, কেহ যাহাতে এহেন অন্যায় করিবার কথা কল্পনাও না করিতে পারে, তাহার জন্যই ফেডারেশনের কঠোর হওয়া উচিত ছিল। একই সঙ্গে স্মরণে রাখা উচিত ছিল, এই অখেলোয়াড়োচিত আচরণ মোহনবাগান এই প্রথম করে নাই। বস্তুত না খেলা, এবং না খেলার হুমকি দেওয়া এই ক্লাবটির নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হইয়াছে। টোলগে ওজবেকে না পাইলে কলিকাতা লিগে খেলিব না, শিল্ড খেলিব না, এয়ারলাইন্স কাপে না খেলিয়াই ট্রফি জিতিব ইদানীং কালে এই জাতীয় ভাবনাচিন্তাই মোহনবাগানে মূলধারায় পরিণত হইয়াছে। এত দিন কোনও সংস্থা সাহস করিয়া মোহনবাগানকে শাস্তি দেয় নাই। এই ইতিহাস স্মরণে রাখিয়া কঠোর হওয়া ফেডারেশনের উচিত ছিল। ফেডারেশন তাহা হয় নাই। ভুল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হইল। ভবিষ্যতে অন্য দলগুলিও এই পথে হাঁটিলে বিস্মিত হওয়া যাইবে না। |