|
|
|
|
প্রথম ত্রিপুরা, দ্বিতীয় অসম |
মাতৃপ্রধান উত্তর-পূর্বে নারীর সম্মানই এখন গভীর সঙ্কটে |
রাজীবাক্ষ রক্ষিত • গুয়াহাটি |
এক দিকে দামিনীর মৃত্যুতে প্রতিবাদে একজোট, অন্য দিকে নারীদের উপরে ক্রমবর্ধমান অত্যাচারের ঘটনা নিয়ে আতঙ্কিত উত্তর-পূর্ব। উত্তর-পূর্বের অধিকাংশ সমাজই মহিলা-প্রধান। অথচ ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণ হোক বা দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা---কোথাও মহিলাদের প্রতি প্রাপ্য সম্মান দেখাচ্ছে না সেই সমাজ। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি তাই খ্রিষ্টান বস্তির রাজপথে গণ-শ্লীলতাহানি, গারো পাহাড়ের গণ-ধর্ষণ বা মণিপুরে শ্লীলতাহানির বদলায় শ্লীলতাহানির ঘটনাকে কাঁধে নিয়ে পুরনো বছরকে পিছনে ফেলে নতুন বছরে পা দিল। গত বছরের পাওনা বলতে, নারীদের বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধের নিরিখে জাতীয় তালিকায় প্রথম দু’টি স্থান দখল করেছে যথাক্রমে ত্রিপুরা (৪০.৭ শতাংশ) ও অসম (৩৬.৯শতাংশ)।
মণিপুর, মিজোরাম, মেঘালয়ের সমাজে বরাবরই নারীদের প্রাধান্য। ব্যবসা সামলানো থেকে ঘর-গেরস্থালি সামলানো, সবেতেই মেয়েদের যে আধিপত্য ছিল, গত কয়েক বছরে তা বড় ধাক্কা খেয়েছে। তবে ভোটে মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ করতে না দিলেও মেয়েদের বিরুদ্ধে অপরাধের হারে অনেকই সংযত নাগাল্যান্ড (১.৯ শতাংশ)। ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন অবধি মেঘালয়ে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংক্রান্ত ৯১টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনাই ৬০টি। যে মণিপুর মহিলা শক্তি, মহিলা সংগঠনের নিরিখে দেশের মধ্যে পয়লা নম্বরে, সেই রাজ্যেই অক্টোবর পর্যন্ত মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের নথিভুক্ত সংখ্যা ২৫১টি। ডিসেম্বর অবধি ২৭টি ধর্ষণ এবং ধর্ষণ করে হত্যার মামলা দায়ের হয়েছে। মাত্র একটি মামলায় চার্জশিট গড়ে বিচার শুরু হয়েছে। গত পাঁচ বছরে দায়রা আদালতে চলা ২০টি ধর্ষণের মামলা এখনও ঝুলছে। অসমের ক্ষেত্রে গত বছর কেবল ধর্ষণের মামলাই দায়ের হয়েছে ২০১১টি। এই বছর অক্টোবর পর্যন্ত সংখ্যাটি ১৪০৯। খ্রিস্টান প্রধান রাজ্য মিজোরামেও নভেম্বর অবধি ধর্ষণের নথিভুক্ত ঘটনা ৯৫টি। অরুণাচলে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা ১২২টি।
কিন্তু অপরাধ বাড়লেও ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’ তো দূরের কথা, শাস্তির সংখ্যাই হাতে গোনা। বিভিন্ন রাজ্যের মহিলা কমিশন ও মহিলা সংগঠনগুলি বারবার ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ আদালতে বিচার চেয়েছে। কিন্তু সেই আদালত গড়াই হচ্ছে না। মামলার দীর্ঘসূত্রতা, পুলিশের চার্জশিট গড়ায় টালবাহানা, রাজ্য সরকারের আইন সংশোধনে অনীহা প্রভৃতি কারণে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন অপরাধীরা। মণিপুরের সরকারি আইনজীবী তেজকুমার বা আইনজীবী বি সুপ্রিয়ার মতে, সুপ্রিম কোর্ট সব আদালতকে ৩৭৬ ও ৩৭৬ এ-ডি ধারার সব মামলা দু’মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশও মানা হচ্ছে না। পুলিশের চার্জশিট দিতেই তো বছর গড়িয়ে যাচ্ছে।
এই গড়িমসি নিয়ে উত্তর-পূর্বের সব রাজ্যের পুলিশ কর্তাদের বক্তব্যই এক: জঙ্গিপ্রবণ রাজ্যগুলিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং ভিআইপি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতেই বছরের অধিকাংশ সময় কেটে যায়। তদন্তের জন্য সময় কোথায়? অথচ প্রকাশ সিংহ বনাম কেন্দ্রীয় সরকারের মামলায় ২০০৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি ওয়াই কে সাভারওয়াল, সি কে ঠক্কর এবং পি কে বালাসুব্রাহ্মনিয়ামের বেঞ্চের রায় ছিল, অবিলম্বে পুলিশের তদন্ত শাখা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার শাখাকে পৃথক করে ফেলা হোক। প্রথমে ১০ লক্ষের বেশি জনসংখ্যার নগর এলাকায় এই ব্যবস্থা কার্যকর করে, পরে সর্বত্র তা চালু করার নির্দেশ ছিল। কিন্তু আজ অবধি কোনও সরকারই এই ব্যাপারে উদ্যোগী হয়নি। গোটা দেশ শ্লীলতাহানি, ধর্ষণের কড়া শাস্তি দাবি করে কেন্দ্রের উপরে চাপ দিচ্ছে। মিজোরামের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিশ্বজিৎ দেব বলেন, “আইন বদলানো সংসদের দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া। কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্ট ও রাজ্য সরকারের হাতে অনেকটা ক্ষমতা রয়েছে। মধ্যপ্রদেশ ইতিমধ্যেই ৩৫৪ ধারাকে সংশোধন করে ‘৩৫৪-এ’ প্রণয়ন করে এই অপরাধকে জামিন অযোগ্য করেছে। ১০ বছর পর্যন্ত সাজার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সেই পথ অন্য রাজ্যগুলিও অনুসরণ করতে পারে। সুপ্রিম কোর্টও ইচ্ছে করলে চার্জ গঠনের পরে, ধর্ষণের মামলার বিচার ৩০৯ সিআরপিসি অনুযায়ী প্রতিদিন করার নির্দেশ দিতে পারে।” মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমার বক্তব্য, “পুলিশকে যেমন অতি-সক্রিয় হতে হবে, তেমনই বিচার দ্রুত শেষ করার ভার নিতে হবে বিচার বিভাগকেই।” অত্যাচারিতদের প্রতি মুকুল সাংমার অনুরোধ, “সমাজের ভয়ে চুপ করে থাকবেন না। মামলা চলাকালীন চাপের কাছে নতিস্বীকার করে আপসেও যাবেন না।” |
|
|
|
|
|