থিকথিকে ভিড়ে সঙ্গীদের থেকে ছিটকে গিয়েছেন মহিলা। চিড়িয়াখানায় বাঘের খাঁচার আশপাশে ঝাড়া আধ ঘণ্টা চরকিপাক দিয়েই চলেছেন। শেষটায় কুমিরের ঘরের কাছে স্বামীকে খুঁজে পেয়ে যেন ধড়ে প্রাণ এল তাঁর। ‘‘উফ্, কোথায় যে যাও” বলতে গিয়ে প্রায় কাঁদো-কাঁদো গড়িয়াহাটের ভাবনা মিত্র।
তিনি একা নন। পয়লা জানুয়ারির চিড়িয়াখানায় যথারীতি অনেকেরই এমন নাজেহাল দশা। শুধু চিড়িয়াখানাই নয়। মিলেনিয়াম পার্ক থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাঠ, সাউথ সিটি মলের ফ্লোর থেকে রাজারহাটের আনকোরা ইকো ট্যুরিজম পার্ক সর্বত্র একই দৃশ্য। বর্ষবরণের রাতের রাজপথে কিছুটা তুরীয় মেজাজে ছিল কলকাতা। মঙ্গলবার পয়লা জানুয়ারির দুপুরের ছবিটা তার পাশে যেন নিখাদ পারিবারিক ‘সোপ-অপেরা’। দাদু-দিদা-কাকু-কাকি-ভাগ্নে-ভাগ্নী-দাদা-বৌদিদের হট্টগোলেই সরগরম।
এই ছুটির মেজাজের কল্যাণেই বহু বছর বাদে নিজের ব্যাডমিন্টন দক্ষতা খানিক ঝালিয়ে নিলেন শোভাবাজারের অরূপ রায়। তিনি হাসছিলেন, “ওহ, আজকাল দমে একটু টান পড়ে।” শুধু ছেলে-মেয়েই নয়, স্ত্রীর সঙ্গেও কিছুক্ষণ র্যাকেটে-র্যাকেটে টক্কর দিলেন অরূপ। শুধু খেলা বা বাঘ-ভালুক দেখার ভিড়ই নয়, নতুন বছরের প্রথম দিনে শহরের একটি প্রধান খাদ্যশালার নামও চিড়িয়াখানা। খোলা মাঠে টিফিন ক্যারিয়ার খুলে পাত পেড়ে লুচি-আলুরদম থেকে কেক-জয়নগরের মোয়ার সদ্ব্যবহার চলছে।
কলকাতার ময়দানও যেন একটা বড়সড় পিকনিকের মাঠ। কেউ ঘোড়া চাপছেন, কেউ আবার ব্যাট হাতে নেমে পড়েছেন। কেউ স্রেফ শতরঞ্চি পেতে ময়দানের মিঠে রোদ উপভোগ করতে করতে চিনেবাদাম খাচ্ছেন। গুছিয়ে বসে টিফিন বাক্স খুলতেই সে-দিকে জুলজুল চোখে তাকাল বাঁদরওয়ালার লাঠির মাথায় বন্দি একরত্তি বাঁদরছানা।
গোটা রেড রোড জুড়েই গিজগিজে ট্রাফিক। ভিক্টোরিয়ায় ঢোকার মুখে লাইন এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে অনেক দূর।
|
শুধু পিকনিকই নয়, ভিক্টোরিয়ার মাঠে শতরঞ্চি পেতে ঘুমোতেও দেখা গেল অনেককে। সোনারপুরের রাহুল মজুমদার প্রতি বছর ভিক্টোরিয়ায় পিকনিক করতে আসেন। এ বারও তার নড়চড় হয়নি। তিনি বলছিলেন, “শীতের আমেজে বাগানটা কী যে সুন্দর লাগে!” এ বার মুম্বইয়ের ক’জন বন্ধুকে ‘কলকাতার তাজমহল’ দেখাতে নিয়ে এসেছেন তিনি।
নিকো পার্কে শীতের কার্নিভ্যাল চলছে। দুপুরে বসেছে ড্রাগন ডান্স, ছৌ নাচের আসরও। ছোটদের মন ভরাতে কেউ বাঘ সেজেছেন, কেউ বা হাঁস! রকমারি রাইডের টানেও লম্বা লাইন। অন্তত আধ ঘণ্টা ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকলে তবে কপালে শিকে ছিঁড়ছে।
ভিড় সামলাতে শীতেও ঘাম ছুটছে সাউথ সিটির কর্তা গৌতম মুখোপাধ্যায়ের। বলছিলেন, নজরদারি আঁটোসাঁটো করতে রক্ষী ও সিসিটিভি দু’টোই বাড়াতে হয়েছে। উত্তর কলকাতার সিঁথি ও হাওড়ার ডুমুরজলায় সার্কাস-তাঁবু ঘিরে উন্মাদনা দেখে কর্তাদের চওড়া হাসি। মরসুমের সব থেকে বেশি ভিড়টা ছিল এ দিনই।
রাজারহাটের ইকো-ট্যুরিজম পার্কে ঢুকতে আধ কিলোমিটার লম্বা লাইন। দু’টো টিকিট কাউন্টারের সামনেই হামলে পড়া ভিড়। টিকিটের জন্য দাঁড়িয়ে প্রায় মারপিট লেগে যাওয়ার উপক্রম। নিউ টাউন থানার পুলিশ কাকুতি-মিনতি করে পরিস্থিতি সামলাচ্ছে। গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাতেও তিলধারণের উপায় নেই। অনেকের অভিযোগ, মাত্র ৪০ থেকে ৫০টি গাড়ি রাখার জায়গা রয়েছে। অথচ, এ দিন ওই তল্লাটে ৩০০-৪০০ গাড়ির ভিড়। নিউ টাউনের সার্ভিস রোডের উপরেই তাদের ঠাঁই হয়েছে।
পার্কে বেড়াতে এসেছিলেন মধুবন্তী দত্ত। বললেন, “সার্ভিস রোডে গাড়ি রাখায় ধুলোয় ভরে যায় পুরো এলাকা। যা লাইন! আধ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তবে সুযোগ পেলাম।” পুলিশ জানায়, ইকো পার্কে লক্ষাধিক লোকের ভিড়। হিডকো-র চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন বলেন, “পার্কে শুরু থেকেই এমন ভিড় হবে, বুঝতে পারিনি। কিছু সমস্যা হচ্ছে। সে-সব সামলাতে বুধবারই জরুরি বৈঠকে বসছি।” |