ধর্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার দাবি করেছিলেন তিনি। বিনিময়ে জোটে ডাকাতের তকমা। এই হেনস্থার প্রতিবাদে কড়েয়া থানার সামনে গায়ে আগুন দেওয়া সেই যুবক মারাই গেলেন মঙ্গলবার।
পাম অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা মির আমিরুল ইসলাম। তাঁর অভিযোগ ছিল, এক নাবালিকাকে এক বছর ধরে ধর্ষণ করার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কড়েয়া থানার পুলিশ এক দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। তাঁর আরও অভিযোগ ছিল, তিনি বিষয়টি নিয়ে সরব হওয়ার পরেই পুলিশ ডাকাতির মামলা দায়ের করে তাঁকে হেনস্থা করছে। পুলিশের এই আচরণের প্রতিবাদে ৩ ডিসেম্বর কড়েয়া থানার সামনে গায়ে আগুন দেন আমিরুল। এ দিন দুপুরে সল্টলেকের একটি হাসপাতালে মৃত্যু হল তাঁর।
পরিবারের অভিযোগ, মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে আমিরুল জানিয়েছিলেন, কয়েক জন পুলিশ অফিসার ধর্ষণের মামলা তোলার জন্য নানা ভাবে চাপ দিচ্ছিলেন। জবানবন্দিতে তাঁদের নামও বলেছিলেন তিনি। লালবাজারের কর্তারা তবু ওই পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি। মামলা তোলার জন্য চাপ দেওয়ার পাশাপাশি তাঁকে গ্রেফতারও করতে চেয়েছিল পুলিশ। এই মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, অভিমানে থানার সামনে গায়ে আগুন দেন আমিরুল।
এ দিন বিকেলে হাসপাতালে তাঁর মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে ভাই আনোয়ার জানান, শেখ শাহজাদা বক্স নামে স্থানীয় এক দুষ্কৃতী এক বছর ধরে ধর্ষণ করছে বলে অভিযোগ করেছিল এক নাবালিকা। ঘটনাটি যাতে জানাজানি না হয়, সে জন্য হুমকিও দিত সে। সন্ধ্যায় আমিরুলের বাড়িতে বসে ওই নাবালিকা নিজেও জানায়, তাদের বাড়ি শাহজাদার বাড়ির পাশেই। গত এক বছর ধরে প্রায় প্রতি দিন দুপুরে শাহজাদা তাকে নিজের বাড়িতে ডেকে নিত এবং ধর্ষণ করত। প্রথমে ভয় পেয়ে সে কাউকে কিছু বলতে পারেনি। পরে মাকে ও পাড়ার লোকেদের সব জানায়। নাবালিকার কথায়, “কাউকে বললে বাড়ির সবাইকে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে, আমার মুখে অ্যাসিড মারা হবে বলে ভয় দেখাত শাহজাদা।”
|
পেশায় গৃহশিক্ষক আমিরুলের বাবা ইজহারুল ইসলাম বলেন, “ঘটনাটি জেনে আমার ছেলে পাড়ার আরও ক’জন যুবককে নিয়ে শাহজাদার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। মেয়েটি ইংরেজি লিখতে পারে না বলে আমিরুলই অভিযোগটি লিখে দেয়। অভিযোগ জানাতে থানাতেও যায়।” ওই লিখিত অভিযোগ পুলিশ প্রথমে নিতে চায়নি বলে অভিযোগ। পরে পাড়ার লোকের চাপে গত ৩১ অক্টোবর অভিযোগটি নেয় পুলিশ।
আনোয়ারের অভিযোগ, যে দিন শাহজাদার বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ নেয়, শাহজাদার স্ত্রী নিলোফার বেগম সেই দিনই আমিরুল ও তাঁর চার বন্ধুর বিরুদ্ধে বাড়ি ভাঙচুর ও ডাকাতির অভিযোগ দায়ের করেন। ইজহারুল বলেন, “আমার ছেলে যখন থানায়
বসে অভিযোগ লিখছে, তখন আর এক টেবিলে বসে নিলোফারও অভিযোগ করছিল। ডাকাতি করলে কেউ থানায় গিয়ে বসে থাকে?” এলাকার বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, শাহজাদার সঙ্গে পুলিশের একাংশের ওঠাবসা রয়েছে। তাই পুলিশ ওর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ও কোণঠাসা করেছে আমিরুলকে।
কী বলছেন লালবাজারের কর্তারা? কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম দাবি করেছেন, “ওই নাবালিকার অভিযোগের ভিত্তিতে শাহজাদাকে পুলিশ আগেই গ্রেফতার করেছে। সে এখন জেল হেফাজতে আছে। আমিরুলের বিরুদ্ধে বাড়ি ভাঙচুর এবং টাকা লুঠের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন শাহজাদার স্ত্রী। কারও বিরুদ্ধে বাড়ি ভাঙচুর এবং টাকা লুঠের অভিযোগ থাকলে পুলিশ তো তদন্ত করবেই।” পুলিশ কর্তারা অভিযোগ করেন, গ্রেফতার এড়াতেই গায়ে আগুন দিয়ে ঘটনার মোড় অন্য দিকে ঘোরাতে চেয়েছিলেন আমিরুল।
কিন্তু আমিরুল যে পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেওয়ার অভিযোগ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “মৃতের পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে এই ধরনের কোনও অভিযোগ এখনও দায়ের করা হয়নি বলেই জানি।”
আমিরুলের আইনজীবী নৌসাদ হুসেন বলেছেন, “যে পুলিশ অফিসাররা ধর্ষণের অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ কড়েয়া থানায় জানানো হবে।” পুলিশি হেনস্থার কথা জানাতে গিয়ে ইজহারুল বলেন, “অন্য কারণে আত্মহত্যা করলে আমার ছেলে বাড়িতে বা অন্য জায়গায় গিয়ে, অন্য কোনও ভাবে তা করতে পারত। নিশ্চয়ই থানার সামনে গিয়ে গায়ে আগুন দিত না।” |