খাস কলকাতায় দিনের বেলায় কটূক্তি করতে করতে এক যুবতীর পিছু নিয়েছে দুই মদ্যপ যুবক। দ্রুত পায়ে হাঁটছেন যুবতী। কিন্তু রক্ষা পেলেন না। ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর টি-শার্টের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিল ওই দুই যুবক। মহিলার চিৎকারে অনেকে ভিড় করলেও সাহায্য করতে কিন্তু এগিয়ে এলেন না কেউই!
ঘটনাস্থল: কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলা ও লালবাজারের মাঝখানে বৌবাজার ও হেয়ার স্ট্রিট থানা থেকে কয়েক হাত দূরের বো স্ট্রিট। সময়: মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটে।
এমন জায়গায়, এমন একটা ঘটনার পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে: দিনদুপুরে থানার কাছেই যদি এক জন মহিলাকে নিগ্রহ করার সাহস পায় দুষ্কৃতীরা, তা হলে রাতবিরেতে, নির্জন এলাকায় তাঁরা কতটা নিরাপদ। তা ছাড়া, দিল্লির গণধর্ষণের প্রতিবাদে গোটা দেশের সঙ্গে যখন গর্জে উঠেছে এই শহরও, তখন ওই মহিলার আর্ত চিৎকার শুনেও কেন কেউ সাড়া দিলেন না, সেটাও বড় বিস্ময়।
কেউ এগিয়ে না এলেও ওই মহিলা অবশ্য নিজেই প্রতিরোধ করেছেন তাঁর নিগ্রহকারীদের। শুধু তা-ই নয়, ঘুরে দাঁড়িয়ে এক দুষ্কৃতীর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছেন থানায়। দুষ্কৃতীর নখের আঁচড়ে রক্তাক্ত হয়েছে তাঁর নিজের হাত। তবু ছাড়েননি। বৌবাজার থানার পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন ওই দুষ্কৃতীকে। তত ক্ষণে চম্পট দিয়েছে অন্য দুষ্কৃতী। পুলিশ জানিয়েছে, তাদের হাতে যে যুবককে তুলে দিয়েছিলেন ওই মহিলা, তার নাম ঘনশ্যাম থাপা।
বৌবাজার থানার দাবি, মহিলা তাদের কাছে আসার পরেই তারা তৎপর হয়ে তদন্তে নেমেছে। ঘনশ্যামকে জেরা করে কিছু ক্ষণের মধ্যেই তার পলাতক সঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার নাম সীতারাম থাপা। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, জ্যাকারিয়া স্ট্রিটের একটি অতিথিশালায় কাজ করে ওই দু’জন। বয়স বছর পঁচিশের মধ্যে। রাতে কলকাতার ডেপুটি কমিশনার (মধ্য) দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ বলেন, “ওই দু’জনের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। বুধবার তাদের আদালতে পেশ করানো হবে।” |
দিল্লির ধর্ষণ-কাণ্ডের পরে মহিলা নিগ্রহের প্রতিবাদে গোটা শহর এখন উত্তাল। মোমবাতি, পোস্টার হাতে পথে নেমেছেন হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু কলকাতা রয়েছে কলকাতাতেই। নারী নিগ্রহে কোনও ইতি পড়েনি। রবিবার রাতেই একটি বেসরকারি বাসে মদ্যপ যুবকের হাতে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছিলেন বরাহনগরের বাসিন্দা এক মহিলা। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনিও। সঙ্গীর সাহায্যে দুষ্কৃতীকে তুলে দিয়েছিলেন কাশীপুর থানার পুলিশের হাতে।
কী ঘটেছে এ দিন বো স্ট্রিটে?
বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাসিন্দা বছর বাইশের ওই যুবতী জানান, বো স্ট্রিটে একটি জামাকাপড় তৈরির দোকানে তিনি প্রায়ই যাতায়াত করেন। এ দিনও তিনি একটি পোশাক তৈরি করাতে গিয়েছিলেন। ফেরার সময়ে নেপালি ভাষায় তাঁকে উত্যক্ত করতে থাকে দুই মদ্যপ যুবক।
মহিলা নিজেও নেপালি। ফলে ভাষা বুঝতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। কিন্তু গুরুত্ব না-দিয়ে তিনি হাঁটতে থাকেন। কিন্তু দেখেন, অশালীন কথা বলতে বলতে যুবক দু’টি তাঁর পিছু নিয়েছে। রাস্তায় কেউ প্রতিবাদ করছে না দেখে তাদের সাহস বাড়ে। যুবতী জানান, পিছন থেকে তাঁর টি-শার্টের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে রাস্তার উপরেই তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে দু’জন। সেটা দেখেও কেউ বাঁচাতে আসেননি।
ওই বিপদের মধ্যেও ভয়ে উপস্থিতবুদ্ধি হারাননি মহিলা। ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনি নিজেই এক যুবককে ধরে ফেলেন। যুবতীর আক্ষেপ, যুবকটিকে পুলিশের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য আশপাশের লোকের সাহায্য চাইলেও কেউ এগিয়ে আসেননি। তিনি বলেন, “পুলিশের কথা শুনেই সবাই দ্রুত সরে পড়েন।
এর পর যুবকটির হাত ধরে টেনে থানার গেটের কাছাকাছি এসে চিৎকার করে পুলিশকে ডাকতে থাকি। তাই শুনে পুলিশ এসে ওকে ধরে।” মহিলা এর পরে ফোন করেন তাঁর স্বামীকে। কিছু ক্ষণ পরে তিনিও থানায় আসেন। মহিলা লিখিত ভাবে অভিযোগ দায়ের করেন ওই দুই যুবকের বিরুদ্ধে।
দিনের আলোয় এমন ঘটনার পাশাপাশি সাহায্য করতে কারও এগিয়ে না-আসাটা বিস্মিত করেছে ওই মহিলাকে। থানায় তিনি বলেন, “এ রকম একটা জায়গায় কেউ এ ভাবে অপমান করবে, তা ভাবতেও পারিনি। আরও অবাক হয়েছি, কেউ সাহায্য করতে আসেনি। কলকাতার রাস্তায় দিনের আলোয় এই ঘটনা দেখেও কেউ প্রতিবাদ করছেন না, তা ভাবতেও পারছি না!”
বছরের প্রথম দিনের এই ঘটনাটি ছাড়াও বর্ষবরণের রাতে নিউ মার্কেট এলাকায় আরও দু’টি শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ জানায়, লিন্ডসে স্ট্রিটে এক মহিলার সঙ্গে অশালীন আচরণের অভিযোগে মুরলী পাসোয়ান নামে এক যুবক গ্রেফতার হয়েছে। ভিড়ের মধ্যে বছর উনিশের ওই যুবক মহিলার সঙ্গে অশালীন আচরণ করলে তিনি প্রতিবাদ করেন। এখানে আশপাশের লোকেরাই অভিযুক্তকে ধরে পুলিশে তুলে দেন।
সোমবার রাতেই কসবার রুবি মোড়ে দুই মহিলার সঙ্গে অশালীন আচরণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে মহিলাদের সঙ্গীদের সঙ্গে কয়েক যুবকের বচসা, হাতাহাতি হয়। দু’পক্ষের অভিযোগ পেয়ে পুলিশ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে। ওই রাতেই নিউ মার্কেট এলাকারই উমাদাস লেনে এক নাবালিকার শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযুক্ত ধরা পড়েনি। |