ত্রিফলা আলো কেলেঙ্কারি এ বার ফাঁস হল শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়িতেও।
সোমবারই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা পুরসভায় ত্রিফলা-সংক্রান্ত আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ দীর্ঘ দিন শিরোনামে থাকায় সংবাদমাধ্যমকেই এক হাত নিলেন। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বললেন “লিখতে শুরু করল, আলো কেন ত্রিফলা হবে? তবে কি দ্বিফলা হবে গলা কাটার জন্য?”
ঘটনাচক্রে, এ দিনই সামনে এল যে শিলিগুড়ি এবং জলপাইগুড়ি শহরেও ত্রিফলা আলো বসাতে গিয়ে বিধি ভেঙে টাকা খরচের কথা ধরা পড়েছে অডিটে। আলো বসানোর বরাত দেওয়া শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এসজেডিএ) বার্ষিক অডিটে এমনই তথ্য ধরা পড়ায় এসজেডিএ-র অনেক সদস্যই ত্রিফলা নিয়ে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা নয়ছয়ের আশঙ্কা করছেন।
চার দফায় প্রায় ১৪ কোটি টাকা খরচে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়িতে ত্রিফলা আলো বসানো হয়েছে। এসজেডিএ সূত্রের খবর, প্রথম দফায় ত্রিফলা বসানোর বরাত দেওয়ার জন্য দরপত্র ডাকা হয়নি। ‘কোটেশন’-এর ভিত্তিতে তৃণমূল নেতাদের একাংশের ‘অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে পরিচিত এক ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকার কাজ। বসানো হয়েছে ৯৯৮টি বাতিস্তম্ভ। তার পর থেকে প্রায় ৭ কোটি টাকা খরচ করে তিন হাজার বাতিস্তম্ভ বসানো হয়েছে। সে ক্ষেত্রেও ওই ঠিকাদারই মোটা টাকার কাজ করেছেন। |
দরপত্র ছাড়াই কাজের বরাত দেওয়া হল কেন? সরাসরি জবাব না দিয়ে এসজেডিএ-র চেয়ারম্যান তথা শিলিগুড়ির তৃণমূল বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “কোটেশনের ভিত্তিতে কাজ দেওয়া নিয়ে অডিটে প্রশ্ন উঠেছে। অফিসার-ইঞ্জিনিয়ারেরা জবাব তৈরি করছেন। বলে দিয়েছি, ভবিষ্যতে কোটেশনের ভিত্তিতে কোনও কাজ দেওয়া যাবে না।” তাঁর সংযোজন, “বিভাগীয় তদন্তে সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। কোনও যোগসাজশ ধরা পড়লে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” এসজেডিএ-র মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক গোদালা কিরণ কুমার জানান, বিভাগীয় পর্যায়ে বিশদে ত্রিফলার প্রতিটি ফাইল খতিয়ে দেখার কাজ শুরু হয়েছে। তাঁর কথায়, “অডিটে যে সব আপত্তি উঠেছে, তার ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রক্রিয়াও চলছে।”
এসজেডিএ-র ত্রিফলা প্রকল্পের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার কাজের অডিট হয়নি। তবে সংস্থার পরিচালন সমিতির সদস্যদের অনেকেই ঘরোয়া বৈঠকে ‘স্বজনপোষণ ও দুর্নীতি’র অভিযোগে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এই অভিযোগ নিয়ে যে সময়ে নানা মহলে হইচই চলছে, তখনই এসজেডিএ-র ক্রয় কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন তৃণমূলেরই নেত্রী জ্যোৎস্না অগ্রবাল। ত্রিফলা আলো কেনার দায় ভবিষ্যতে ক্রয় কমিটির ঘাড়ে পড়তে পারে, ভেবেই কি ইস্তফা? জ্যোৎস্নাদেবীর বক্তব্য, “কেন ইস্তফা, তা দলের জেলা সভাপতি তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব ও দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানিয়েছি।” উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রীর বক্তব্য, “খোঁজ না নিয়ে কিছু বলতে পারব না।”
অডিটে উঠে-আসা তথ্য কিন্তু অনেককেই ভাবাচ্ছে। কলকাতায় প্রতিটি বাতিস্তম্ভ কেনার খরচ ১৭,৯৬০ টাকা। বসানোর পরে সেই বাতিস্তম্ভ-পিছু খরচ দাঁড়ায় ২৫,৬৯১ টাকা। শিলিগুড়িতে প্রথম পর্যায়ে ২৮,২৪৭ টাকা খরচ হয়েছে স্তম্ভ-পিছু। যদিও তা কেনা হয়েছে কলকাতার দরেই। পরের পর্যায়ে কাওয়াখালিতে একই মডেলের বাতিস্তম্ভ বসানো হয়েছে। কেনার দাম-সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে খরচ ১৯,৭৯০ টাকা। তাই দ্বিতীয় দফায় আগের চেয়ে কম দরে কী ভাবে কাজ হল, প্রশ্ন তুলেছেন এসজেডিএ-র অনেক সদস্যই। তাঁদের বক্তব্য, দ্বিতীয় দফার দরে কাজ হলে প্রকল্পের অন্তত ৫ কোটি টাকা বাঁচানো যেত। |
ত্রিফলা প্রকল্পে গোড়া থেকেই পরিকল্পনার ছাপ ছিল না বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এসজেডিএ-র কিছু সদস্য-সদস্যা। তাঁদের বক্তব্য, দার্জিলিং মোড় থেকে বাগডোগরা বিমানবন্দর পর্যন্ত রাস্তা জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের অধীন। তবু তাঁদের অনুমতি ছাড়াই ওই রাস্তার দু’ধারে ত্রিফলা বসানোর বরাত দিয়েছিল এসজেডিএ। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ আপত্তি করায় কাজ বন্ধ করতে হয়। ‘তড়িঘড়ি’ এক হাজার বাতিস্তম্ভ সেখান থেকে তুলে মাটিগাড়া ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের কাওয়াখালিতে সাড়ে চার কিলোমিটার রাস্তা এবং দু’টি পুকুরের পাড় ঘিরে বসানো হয়।
ফাঁকা মাঠের পাশে অত আলো দেখে থ এলাকাবাসী। তা কানে যেতে বোর্ড-বৈঠক ছাড়াই কাওয়াখালির বাতিস্তম্ভগুলোর মধ্যের দূরত্ব কমিয়ে ১০ মিটার (ছিল অন্তত ২০ মিটার) করা হয়। ১০ মিটার পর্যাপ্ত দূরত্ব কি না প্রশ্ন ওঠায় এখন কিছু বাতিস্তম্ভ তুলে বেশি দূরত্বে বসানো হচ্ছে। মাটিগাড়ার কংগ্রেস বিধায়ক ও এসজেডিএ-র সদস্য শঙ্কর মালাকারের বক্তব্য, “হুড়োহুড়ি করে অপব্যয় করলে মানুষ ছেড়ে কথা বলবে না। যা ঘটছে, তার ব্যাখ্যা জনতাকে দেওয়া দরকার।” ত্রিফলা প্রকল্পের সামগ্রিক কাজের মান নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
জলপাইগুড়ি শহরে ত্রিফলা বসাতে ২ কোটি টাকা খরচ করছে এসজেডিএ। কিছুটা কাজ হওয়ার পরে অভিযোগ ওঠায় কাজ সাময়িক স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন জলপাইগুড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান তথা কংগ্রেস নেতা মোহন বসু। তিনি বলেন, “এসজেডিএ মর্জিমাফিক কাজ করছে। তাই এখন কাজ বন্ধ রাখতে বলেছি।”
এসজেডিএ-র চেয়ারম্যানের বক্তব্য, “প্রথম দফায় ত্রিফলা আলো বসানোর ক্ষেত্রে সত্যিই তাড়াহুড়ো হয়েছে। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গ উৎসবের প্রাক্কালে (গত বছরের গোড়ায়) ওই আলো বসানোর কাজ সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বাকি যা হয়েছে, এসজেডিএ-র সব সদস্যের সঙ্গে আলোচলার ভিত্তিতেই হয়েছে।”
কিন্তু একই ঠিকাদার সংস্থা প্রথমে যে দরে কাজ করেছে, পরে তার চেয়ে প্রায় ২৫% কমে একই কাজ করল কী করে? এসজেডিএ মানলই বা কেন? চেয়ারম্যান বলেন, “আপাতদৃষ্টিতে দেখলে দুর্নীতি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সরকারি বিধি অনুযায়ী, কলকাতায় ঠিকাদারেরা যত শতাংশ লাভ ধরেন, শিলিগুড়িতে তার চেয়ে একটু বেশি ধরতে পারেন। তাই প্রথমে বেশি দরে কাজ করেছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। পরে প্রতিযোগিতার মুখে পড়ায় ঠিকাদার যদি কম লাভে কাজ করেন, আমরা কী করতে পারি?” প্রায় একই সুরে ত্রিফলা প্রকল্পের সঙ্গে আগাগোড়া যুক্ত ঠিকাদার সুব্রত দত্ত বলেন, “প্রথমে বেশি দরে কাজ করেছি। পরে প্রতিযোগিতা বাড়ায় ব্যবসা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রায় বিনা লাভে কাজ কাজ করছি। বিধি ভেঙে কিছু করিনি।” ত্রিফলা নিয়ে অন্ধকার এত সহজে কাটার নয়, বলছেন এসজেডিএ-র ভিতরের লোকজনই। |