|
|
|
|
ওডাফা-চিডির বন্ধুরাই এখন সার্কাসের মুশকিল আসান |
ঋজু বসু • কলকাতা |
শীতের রাত। তাঁবুতে শুয়ে মোবাইলে বান্ধবী উশির সঙ্গে গল্পে বিভোর চেঙ্গো রুয়া ওরফে জনসন। হিসেব কষছেন, কত টাকা জমলে এক সঙ্গে ঘর বাঁধা যায়!
সোয়াহিলি ভাষায় আদরের ডাক ছুটছে সিঁথির মোড় থেকে মোম্বাসা। তিন-তিনটে শোয়ের ধকল শেষে কলকাতার ক্লান্ত রাতে মুক্তির স্বাদ। জনসনের পাড়ার বন্ধু নাম ম্যাকডোনাল্ড ম্যারিগা। তিনি এখন ইন্টার মিলানের মিডফিল্ডার। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে কেনিয়ার প্রথম ফুটবলার। আর রুজি-রুটির টানে কেনিয়া থেকে জনসন এই সিঁথির মাঠে। আফ্রিকান রাশিয়ান ফেমাস সার্কাসের তাঁবুতে।
তানজানিয়ার দার-এস-সালামের হামজা, ইদি, চান্দ, মুসা বা কেনিয়ার সৈদ, মাশা, ইউসুফদের জীবনের গল্পও এক ধাঁচের। সুজি, ভাত, মাংস দেশের কায়দায় ফুটিয়ে খাচ্ছেন। শোয়ের আগে কাঁধ ধরাধরি করে প্রার্থনা। কেউ মুসলিম, কেউ খ্রিস্টান। কিন্তু সমবেত প্রার্থনায় একজোট। এর পরেই সিঁথির মোড় বা হাওড়ার ডুমুরজলায় সার্কাসের রিংয়ে তাঁদের লম্ফঝম্প দেখবে ছেলেবুড়ো সক্কলে।
কলকাতা-হাওড়াই নয়! সার্কাসে আফ্রিকার মানুষদের দাপট এই শীতে শিলিগুড়ি থেকে চেন্নাই, কোচবিহার-ডালখোলা থেকে থানে-বান্দ্রায়। ওডাফা সবুজ-মেরুনের বা চিডি-ওপারা লাল-হলুদের চোখের মণি হয়ে ওঠার মতো এ দেশের সার্কাসও আফ্রিকানদের চক্ষে হারাচ্ছে। অ্যাক্রোব্যাটিক্সে তুখোড় আফ্রিকান শিল্পীরা না-থাকলে এ দেশের সার্কাস-তাঁবুতেও অন্ধকার নেমে আসবে। |
|
প্রস্তুত হচ্ছেন আফ্রিকান শিল্পীরা। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী |
উনিশ শতকে বাঙালির সার্কাসের আদি যুগে নাম কিনেছিল প্রিয়নাথ বসুর গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস। রুশ, জার্মান, ইতালীয়, মার্কিনরা থাকলেও দেশজ প্রতিভারা কম যেতেন না। বাঙালি মেয়েরা তখন বাঘের খেলাও দেখাতেন। বছর ৫০ আগে সুবোধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইন্টারন্যাশনাল সার্কাস ঘরের ছেলেমেয়েদের নিয়েই জাপান-সফর করেছে। বুকের উপরে হাতি তুলতে চৌকস রেবা রক্ষিতের নামে এখনও সমীহে কপালে হাত ঠেকান দেশের তাবৎ সার্কাস-মালিক। এ রাজ্যেই ঐতিহ্যশালী অলিম্পিক, ফেমাস, অজন্তা বা নটরাজ সার্কাসকে নামের আগে এখন আফ্রিকান শব্দটা বসিয়ে লোক টানতে হচ্ছে। কেরলের তেল্লিচেরির শতক ছুঁই ছুঁই গ্রেট বম্বে সার্কাস বা কমল হাসানের আপ্পু রাজা-খ্যাত জেমিনি সার্কাসও এক পথের পথিক। দিল্লির কারকারডুমা মেট্রো স্টেশনের কাছে তাঁবু ফেলেছে বম্বে সার্কাস। তাদের মালিক তথা দেশের সার্কাস-মালিকদের ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক দিলীপনাথ নায়ার মানছেন, “হাই-টেক বিনোদনের যুগে ঘুরে দাঁড়াতে এটাই উপায়।”
এক যুগ আগে বাঘ-সিংহের খেলা নিষিদ্ধ হওয়ায় অথৈ জলে পড়েছে এ দেশের সার্কাস। কম রোজগার, ঝুঁকি অঢেল! তাই একদা জিমন্যাস্টিক্সে দক্ষ কেরল, মহারাষ্ট্র বা বাংলার খেলোয়াড়েরাও সার্কাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। অলিম্পিক ও ফেমাস সার্কাসের চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বা কোহিনুর সার্কাসের জাফর হুসেনের আক্ষেপ, নতুন খেলোয়াড় আর উঠছে না। দিলীপনাথ বলছেন, “বাচ্চাদের জিমন্যাস্টিক্স-সাঁতার শিখিয়ে চিন কামাল করছে। ছোট থেকে না-শেখালে নতুন ছেলেমেয়ে আসবে কোত্থেকে?”
চন্দ্রনাথবাবুর কথায়, “গরিব নেপালি ছেলেমেয়েরা দলে ভারী। তবে আফ্রিকান শিল্পীদের খেলাই প্রধান আকর্ষণ।” তিন ঘণ্টার শোয়ে ওই খেলুড়েদের পাঁচ-ছ’টা আইটেম থাকছে। আফ্রিকার কেনিয়া, তানজানিয়া, ইথিওপিয়া ছাড়া মঙ্গোলিয়া, আর্মেনিয়ার খেলোয়াড়রাও আসেন। সিডি দেখে বাছাই-পর্ব। বিদেশি খেলুড়ে সরবরাহের এজেন্ট মহম্মদ সামসাদের কথায়, “ছ’মাসের ভিসা নিয়ে বিদেশিরা মাসে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা রোজগার করছেন।”
বলিউডের ভক্ত ছোট্টখাট্টো কেনীয় যুবক মাশা হিন্দিতে ফোড়ন কাটেন, “পয়সা সব সে অচ্ছা!” ভারতীয় রান্নায় বিচ্ছিরি ঝাল, বাড়ি ছেড়ে থাকতে ভাল্লাগে না, তবু উপায় নেই!
গত এক দশকে কেনিয়ার বহু গরিব ছেলেমেয়ের জীবন পাল্টে দিয়েছে সার্কাস। সৌজন্যে, কর্পোরেট-প্রকল্পে গড়ে ওঠা সার্কাস স্কুল। তানজানিয়ার মামা আফ্রিকা সার্কাসও নামজাদা। তাদের শ’দেড়েক খেলোয়াড় এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু দেশ ও মঙ্গোলিয়াও সার্কাস-অন্ত-প্রাণ। ফেমাস সার্কাসের বিজ্ঞাপনে রাশিয়ান শব্দটির পিছনে তিন মঙ্গোলিয়ান তন্বী ও এক তরুণ। তাঁদের মধ্যে ‘হুলা হুপ-গার্ল’ বাতচিমেগ এক-আধটা ইংরেজি জানেন। খান চারেক রিং (হুপ) নিয়ে মহড়ার ফাঁকে কথা বলতে গিয়ে হেসেই কুটিপাটি। কোনও মতে বোঝালেন, কচি বয়স থেকেই এই কসরত রপ্ত করেছেন।
এই ছবির উল্টো পিঠেই তেল্লিচেরিতে দেশের সরকারি সার্কাস স্কুল। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সার্কাস-মালিকদের সমন্বয়ের অভাবে সেখানে কাজ থমকে। এই অবস্থায় সোয়াহিলি ভাষার একটা শব্দই সার্কাস-শিল্পের ভরসা। লায়ন কিং ছবির সূত্রে শব্দটা অনেকেরই চেনা।
হাকুনা মাতাতা। মুশকিল আসান। |
|
|
|
|
|