নিজস্ব সংবাদদাতা • শান্তিনিকেতন |
ঠান্ডা পানীয়, বিদেশি প্রসাধন সামগ্রী থেকে মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিংমেশিন এখানে মিলছে সবই। এটা কোনও শপিং মলের ছবি নয়। এ সবই মিলছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধের পৌষমেলায়! আশ্রমিকদের অভিযোগ, পৌষমেলার প্রকৃত চরিত্র বদলে দেওয়া হচ্ছে। গ্রামীণ কুটির বা হস্তশিল্পের জায়গা দখল করে নিচ্ছে বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থার স্টল।
বিশিষ্ট চিত্রকর যোগেন চৌধুরীর ক্ষোভ, “কুটিরশিল্প ও লোকসংস্কৃতিই ছিল পৌষমেলার প্রাণ। এখন সেখানে তাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয় না!” পৌষমেলার চরিত্র ‘বদলে’ বিরক্ত প্রবীণ আশ্রমিক, রবীন্দ্র গবেষক সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “গুরুদেব তো এই মেলা চাননি! বহুজাতিক সংস্থা বড় বড় স্টল দিয়ে মেলায় বিক্রি শুরু করেছে। এ তো এক ধরনের দ্বিচারিতারই সামিল!” পৌষমেলায় যাবেন না ঠিক করেছেন আর এক প্রবীণ আশ্রমিক, প্রখ্যাত গায়ক মোহন সিংহ খাঙ্গুরা। “বাড়িতে বসেই পুরনো দিনের পৌষমেলার স্মৃতিচারণ করে এ কটা দিন কাটাতে চাই।” বললেন তিনি। |
মেলার চরিত্র বদল নিয়ে অভিযোগ অবশ্য মানতে নারাজ মেলা কর্তৃপক্ষ। তাঁদের দাবি, গ্রামীণ চরিত্র টিকিয়ে রাখার সব রকমের চেষ্টা করা হচ্ছে। আর আগামী দিনে তার জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেও তাঁরা পিছপা হবেন না বলেই পৌষমেলা কর্তৃপক্ষের দাবি।
কিন্তু আসলে কী বলছে শতাব্দী প্রাচীন এই পৌষমেলা?
বিজ্ঞাপনের ছোট-বড় হোর্ডিং থেকে মূল মেলা প্রাঙ্গণের স্টলসর্বত্রই দেখা মিলছে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার সামগ্রীর। স্টলগুলোর দিকে একটু এগোতেই পরিচয় হল ভুবনডাঙার বাসিন্দা ঝন্টু আস্তা-র সঙ্গে। তিনি জানালেন, “একটা টিভি কেনার ইচ্ছা আছে। হাতের কাছেই পেয়ে গেলাম। তাই একটু ঢুঁ মেরে দেখে নিলাম।” ভালই সাড়া পাচ্ছেন বলে দাবি করলেন মেলায় স্টল দেওয়া একটি টিভি সংস্থার কর্তা।
অন্য দিকে, প্রদীপের তলায় অন্ধকারের মতোই এই শীতেও খোলা আকাশের নীচেই মাটিতে সামগ্রী বিক্রি করছেন একদল মানুষ। তাঁদের কোনও স্টল নেই। তাঁদের নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না মেলা কর্তৃপক্ষের। কিন্তু এমন বিকিকিনির প্রতিই বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন বাইরে থেকে আসা মানুষ। কলকাতা থেকে আসা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নন্দিনী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব, “দেখুন ও সব জিনিস (বহুজাতিক সংস্থার সামগ্রী) বহু জায়গাতেই পাওয়া যায়। খামোখা পৌষমেলায় তা কিনতে আসব কেন?” পৌষমেলায় এসে প্রায় প্রতি বছরই ডোকরার অলঙ্কার সামগ্রী নিয়ে যান নন্দিনী।
বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে বহু বছর ধরে পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে পৌষমেলায় আসছেন তপন চিত্রকর-রা। তাঁর ক্ষোভ, “রাজ্য সরকারের মেলায় শিল্পীদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা দেওয়া হয়। অথচ পৌষমেলায় অনির্দিষ্ট জায়গায় মাটিতেই বিনা আচ্ছাদনে বসতে হয়। এখানে আমাদের মতো গ্রামাঞ্চল থেকে আসা হস্তশিল্পীদের জন্য কি কিছু করা যায় না?” একই অবস্থা ডোকরা শিল্পী সুদেব পাল, বাঁশের শিল্পী জবা দাস বা বেত শিল্পী সুলগ্না পাঠকেরও। প্রত্যকেরই দাবি, “স্টল দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও মেলা কর্তৃপক্ষের তার জন্য যা টাকা নেন, তা আমাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।” ফলে রুজির টানের পাশাপাশি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে আসা গ্রামীণ শিল্পীকুল থেকে যাচ্ছেন সেই তিমিরেই। |
মেলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকে বিশ্বভারতী কর্মমণ্ডলী। তবে মেলায় ঠিক ক’টি স্থায়ী স্টল হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি তাঁরা। তাঁদের দাবি, ১১০০-র সামান্য বেশি। এ ছাড়া বিনা পয়সায় অস্থায়ী ভাবে শ’ তিনেক স্টলের জায়গায় বসে বিভিন্ন শিল্পকর্ম বিক্রি করতে অনুমতি দিয়েছে মেলা কর্তৃপক্ষ। বিশ্বভারতী কর্মমণ্ডলীর যুগ্ম সম্পাদক সৌগত সামন্তের দাবি, “উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্তের নির্দেশে মেলার প্রথম বৈঠক থেকেই হস্ত ও কুটিরশিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্টল বিলির ক্ষেত্রে তাঁরাই অগ্রাধিকার পেয়েছেন।” মেলা কর্তৃপক্ষের সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্গফুট পিছু ১৭০ টাকা দরে স্টলের জায়গা দেওয়া হয়েছে। সৌগতবাবুর দাবি, কমবেশি ১২০০ স্টলের মধ্যে বহুজাতিক সংস্থার স্টল বড়জোর ৫০-৫৫টি। শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের পক্ষে সম্পাদক অনিল কোনারের বক্তব, “সময়ের সঙ্গে মানুষের চাহিদা ও রুচি পাল্টাচ্ছে। তাই মেলায় বিভিন্ন রকমের স্টল হচ্ছে। বহুজাতিক সংস্থার স্টল আছে মাত্র ৪-৫ শতাংশ। আমরা মূলত কুটিরশিল্পীকেই প্রাধান্য দিই।”
মেলা কর্তৃপক্ষ মুখে যাই বলুন, মেলা ঘুরে কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ যে উদ্দেশ্যে এই মেলা শুরু করেছিলেন, সেই গ্রামীণ শিল্পের এমন বিকিকিনি তার থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছে শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা। বাঁকুড়ার পটশিল্পী শঙ্কর দাস, সিউড়ির কাঠের হস্ত শিল্পী লক্ষ্মণ পাত্র, হুগলির ডোকরা শিল্পী সুদর্শন দাস-রা এখনও বলে চলেছেন, “আমরা গরিব মানুষ। পেটের টানে আসি। কম টাকায় মাথার উপর ছাউনি দিলে ভাল হয়। থাকার ব্যবস্থা হলে ভাল হয়।”
|