‘অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালিও সাম্প্রদায়িক। আমাদের রাজনীতির ধরন হল, পদে পদে মনে করিয়ে
দেওয়া যে হিন্দু আর মুসলমান পরস্পরের ‘আদার’। ব্রিটিশের তৈরি ভ্রান্ত ইতিহাসকে
এই ভাবেই
আমরা ঘাড়ে বয়ে চলি।’ ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী’র সঙ্গে কথা বললেন
গৌতম চক্রবর্তী |
ভারতীয় গণতন্ত্র আজ বিপন্ন। জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা আর দুর্নীতি তাকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। নাগরিকদের সুখদুঃখের চেতনাও সামরিক বুটের চাপে পিষ্ট। ‘‘কাশ্মীরে ভারতীয় সেনা প্রায় ৮৫ হাজার তরুণতরুণীকে খতম করে দিয়েছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরামেও সামরিক বাহিনীর হাতে শেষ হয়ে যাওয়া নাগরিকের সংখ্যা অক্লেশে কাশ্মীরের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এ সবের পরও দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রের বাসিন্দা হিসেবে আমরা গর্ব করব?’’ সম্প্রতি বেঙ্গল ক্লাবে ‘ভারতীয় রাজনীতির ধারা’ নিয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রশ্ন তুললেন ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী।
কিন্তু জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা তো বরাবরই ভারতীয় সমাজের ক্যান্সার হয়ে রয়েছে! অনুষ্ঠানের পর এক আড্ডায় সংশয় জানিয়েছিলাম। তপনবাবু সটান নাকচ করে দিলেন, “হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা ব্রিটিশদের সৃষ্টি। ওঁদের আগে সাম্প্রদায়িকতার এই বিষবৃক্ষ ডালপালা মেলেনি।”
পুরো দায় ইংরেজ শাসকদের ঘাড়ে এ ভাবে চাপিয়ে দেওয়া চায়? মধ্যযুগেও তো হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হত। ঔরংজেবের হিন্দুবিদ্বেষ, জোর করে ধর্মান্তরকরণ, হিন্দু মন্দির ভাঙচুর করা ভুলে যেতে হবে? ইতিহাসবিদের যুক্তি, “জোর করে ধর্মান্তরকরণের কিছু ঘটনা হয়েছিল। সেটা ভয় দেখাতে, প্রজাদের রাজশক্তির তাঁবে রাখতে। মুসলমান শাসকরা এক-আধ বছর রাজত্ব করেননি। প্রথমে পাঠান, তার পর মুঘল। এই কয়েকশো বছর যদি শাসকেরা শুধুই প্রজাদের ধর্মান্তর করতেন, দেশে হিন্দু থাকত না। সবাই মুসলমান হয়ে যেত!”
ঔরংজেবের হিন্দুবিদ্বেষের কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন যদুনাথ সরকারের ছাত্র, “আমরা খেয়াল রাখি না, তারকেশ্বর মন্দিরের জমিটা খোদ ঔরংজেবের দেওয়া। হিন্দু মন্দির ধ্বংস করব বলেই ঔরংজেব রাস্তায় নামেননি। প্রতিটি ধ্বংসের পিছনে আলাদা কারণ ছিল। কখনও ভেবেছেন, এই মন্দির ধ্বংস করলে রাজপুতরা বাড়াবাড়ি করবে না। কখনও ভেবেছেন, ওই মন্দির গুঁড়িয়ে দিলে বুন্দেলা রাজারা তাঁর পথে কাঁটা হবেন না। আমদাবাদের শাসক জোর করে ধর্মান্তরকরণ ঘটিয়েছিলেন। শ্রেষ্ঠী এবং বণিকেরা তার প্রতিবাদ করেছিলেন। অর্থনীতির দায়ে মুঘল সম্রাট ওই শাসককে সরিয়ে দেন।
কিন্তু মধ্যযুগেও দাঙ্গা হত যে! তপনবাবু উড়িয়ে দিলেন: মুঘল আমলে চার-পাঁচটার বেশি সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা পাবেন না। এবং তার একটাও ‘কাফেরদের মারতে হবে’ মার্কা ইস্যুতে শুরু হয়নি। সবই প্রকাশ্য রাস্তায় গরু জবাই করা গোছের তুচ্ছ ইস্যুতে।
হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার ধারণাটা তা হলে এল কোথা থেকে? ইউরোপের ইতিহাসে বারংবার ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে হানাহানি। কখনও রোমানরা খ্রিস্টানদের ওপর অত্যাচার করছে, কখনও খ্রিস্টানরা ইহুদিদের ওপরে। কখনও জেরুজালেম মুক্ত করতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড। কখনও ক্যাথলিক-প্রোটেস্টান্ট হানাহানি। “টলারেন্স’ কথাটায় ভারতবর্ষ ছাড়া কেউ বিশ্বাস রাখেনি,” বলছিলেন তপনবাবু।
ইতিহাসের সেই অভিজ্ঞতা থেকেই ব্রিটিশদের ভারত শাসন। ফলে তাদের মনে হয়েছিল, হিন্দু এবং মুসলিম দুই আলাদা সম্প্রদায়। এদের মধ্যে বৈরিতা থাকবেই। কিন্তু বিশ শতকের শুরুতেও ভারতীয় অভিজ্ঞতা অন্য রকম। অক্সফোর্ডে তপনবাবুর প্রতিবেশী, প্রয়াত নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁর ছেলেবেলায় দুর্গাপুজোয় বলিদানের অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন। পাঁঠাগুলি বলির আগে যত জোরে ‘ম্যা ম্যা’ চিৎকার করত, মুসলমান বাজনদারেরাও তত জোরে বাদ্যি বাজাত। হিন্দুর পুজোয় মুসলমানরাও যোগ দিতেন! ছোঁয়াছুঁয়ি ছিল, কিন্তু তা শুধু হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে নয়, হিন্দুসমাজের বিভিন্ন স্তরে। নীরদবাবুকেই তাঁর গুরুজনেরা এক বার বকেছিলেন, “সতীশ দে-কে ফরাসে বসিয়েছিস?” বাড়ির ভাণ্ডারীর নাতি সতীশকে ফরাসে নয়, পিঁড়িতে বসানো উচিত।
ব্রিটিশ ক্ষমতার ওই ভ্রান্ত ‘পারসেপশন’ ক্রমে বদ্ধমূল হয়ে গেল। জিন্না পাকিস্তান চেয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৪৬ সালের আগে পাকিস্তান ধারণাটি স্পষ্ট ছিল না। “ছোটবেলায় স্লোগান শুনেছি, দেশকে নাম হিন্দুস্থান/ উসকা অন্দর পাকিস্তান”। ভ্রান্ত ইতিহাসবোধের বশবর্তী হয়েই গোলওয়ালকর, আর এস এস এবং হিন্দুত্ববাদের রমরমা। হিন্দুদের অধীনে মুসলমানদের থাকতে হবে, এ রকমটাই ছিল গোলওয়ালকরের দর্শন। স্বাধীনতার পর রাজেশ্বর দয়াল উত্তরপ্রদেশ সরকারের সচিব। আত্মজীবনীতে তিনি জানিয়েছেন, গোলওয়ালকরের ঘরে পুলিশি তল্লাশি চালিয়ে একটি মানচিত্র উদ্ধার হয়েছিল। রাজ্যের মুসলিম গ্রামগুলির মানচিত্র। গোলওয়ালকর গ্রামগুলিতে লুঠতরাজ ও গণহত্যার ছক কষেছিলেন। দয়াল তখনই তাঁকে গ্রেফতারের অনুমতি চান, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ নানা টালবাহানায় এক মাস কাটিয়ে দেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা বেরোলে দেখা গেল, গোলওয়ালকর পগার পার। কয়েক দিন পর নাথুরাম গডসের হাতে গাঁধীহত্যা। তপনবাবুর বক্তব্য, গোলওয়ালকরকে ঠিক সময়ে ধরলে আজ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এ ভাবে মাত্রা ছাড়াত না।
কিন্তু বিদ্বেষের ইতিহাসকে গুরুত্ব দিয়ে লাভ? গোধরা গণহত্যার পরও নরেন্দ্র মোদী ভোটে জিতেছেন, গুজরাতে উন্নয়নের সুপবন বইয়ে দিয়েছেন। মানুষ তাঁকে উন্নয়নের কাণ্ডারী ভাবেন বলেই ভোট দেন! “প্রোপাগান্ডা! গুজরাতে ধনী-গরিব ফারাক অন্য রাজ্যের চেয়ে বেশি, প্রায় ৩২ শতাংশ গরিব। উন্নয়নের জন্য নয়, মুসলিম-বিদ্বেষের কারণেই হিন্দুরা মোদীকে ত্রাতা মনে করে।” শুধু গুজরাত কেন? অধিকাংশ বাঙালি হিন্দুর মনেও রয়েছে এই সাম্প্রদায়িক চেতনা। “সকালে লেকের ধারে হাঁটতে যাই। বেঞ্চে বেশির ভাগ মানুষের মুখে শুনি একই আলোচনা। মোদী দেশের হাল ধরলে সব ঠিক হয়ে যাবে! শিক্ষিত বাঙালি অসাম্প্রদায়িক, হিন্দু-মুসলিম ভেদে বিশ্বাস করে না... এর চেয়ে মিথ্যে আর হয় না,” উত্তেজিত ইতিহাসবিদ।
কিন্তু মোদী আজকাল স্বামী বিবেকানন্দের কথাও বলেন! “গর্দভ সিংহের চামড়া পরে নিল, আর তাতে গলে গেলেন? বিবেকানন্দের ভারতচেতনা অন্য। হিন্দুর মস্তিষ্ক, ইসলামিক পেশি। নরেন্দ্র মোদী ওই সমন্বয়ে কবে বিশ্বাস রাখলেন?”
পশ্চিমবঙ্গ অবশ্য অন্য রকম। এখানে মুখ্যমন্ত্রী ইমামদের মাসিক ভাতার বন্দোবস্ত করেছেন। হাসলেন ইতিহাসবিদ, “গোধরার সময় উনি বিজেপি মন্ত্রিসভার শরিক ছিলেন। একটি কথাও বলেননি। মুসলিমদের জন্য চোখের জল তখন কোথায় ছিল? আর মুসলিম সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের উন্নতি না ঘটিয়ে শুধু মসজিদের ইমামদের জন্য উপহার? গোঁড়া মুসলিমের সংখ্যা বাড়বে, তার প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের মনে সাম্প্রদায়িকতা বাড়বে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানে বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান সকলে। কিন্তু আমাদের রাজনীতির ধরনটা হল, পদে পদে মনে করিয়ে দেওয়া হিন্দু আর মুসলমান পরস্পরের ‘আদার’। ব্রিটিশের তৈরি ভ্রান্ত ইতিহাসকে আমরা এ ভাবেই প্রশ্রয় দিই, পদে পদে তাকে ঘাড়ে বয়ে চলি।’’
কে জানত, স্বাধীনতার সাড়ে ছয় দশক পরেও এই ভ্রান্ত চেতনা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না! |