কলকাতার পরে দিল্লি। লগ্নি টানার চেষ্টায় ফের শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু রাজ্যে লগ্নির ক্ষেত্রে শিল্পপতিদের সংশয় মুছতে আজও কোনও আশ্বাসবাণী শোনালেন না তিনি।
এ দিনের সম্মেলনে যে ৪২ জন শিল্পপতি মমতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তাঁরা কেউ-ই সেই অর্থে প্রথম সারির নন। মুকেশ অম্বানী ছিলেন না। এসেছিলেন তাঁর সংস্থার প্রতিনিধি। হিরো মোটো কর্পের তরফে এমডি তথা সিইও পবন মুঞ্জল নয়, ছিলেন জয়েন্ট এমডি সুনীল মুঞ্জল। ভারতী এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান সুনীল মিত্তলের বদলে ছিলেন
ভাইস চেয়ারম্যান রাজন মিত্তল। ফলে সব মিলিয়ে এই সম্মেলনকে শিল্পপতিরা খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না, এমনটাই মত ছিল শিল্পমহলের একটা বড় অংশের। তার পরেও দেখার ছিল, মমতা নতুন কোনও কথা শোনান কি না। আর্থিক সংস্কার এবং জমি সমস্যা নিয়ে লগ্নিকারীদের প্রত্যাশা পূরণ করেন কি না। কিন্তু দিনের শেষে এই সম্মেলন বেঙ্গল লিড্স বা বিজয়া সম্মেলনের চর্বিত চর্বণ হয়েই রইল বলে মনে করছেন শিল্পপতিদের একাংশ।
মমতা নিজে অবশ্য আজকের বৈঠক নিয়ে প্রবল উৎসাহী। শিল্পপতিদের তিনি বলেন, তাঁর কোনও সংবাদমাধ্যম নেই। তাঁর হয়ে বলার কেউ নেই। তাই তিনি নিজেই নিজের কথা বলতে এসেছেন। আর বৈঠকের পরে মমতার মন্তব্য, “আগে একটা ধারণা ছিল, রাজ্যে কিছু নেই। আজ আমরা আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছি। এবং শিল্পপতিরা খুবই খুশি। তাঁরা রাজ্যে বিনিয়োগ করবেন বলেছেন।” |
কিন্তু ঘটনা হল, এ দিনের বৈঠকে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি (এফডিআই) নিয়ে অবস্থান বদলানোর জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন হিরো মোটো কর্পের সুনীল মুঞ্জল। জবাবে কোনও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেননি মুখ্যমন্ত্রী। এর পর বৈঠক শেষ হওয়ার আধ ঘণ্টা আগেই সুনীলের চলে যাওয়ায় গুঞ্জন তৈরি হয়। অনেকেই বলেন, সুনীল ওয়াক আউট করেছেন। তৃণমূল শিবিরের অবশ্য দাবি, সুনীল মোটেই ওয়াকআউট করেননি। বিশেষ কাজ থাকায় আগে চলে গিয়েছেন।
মূলত যে সব প্রশ্নে রাজ্যে বিনিয়োগ থমকে আছে, সেগুলির নতুন কোনও জবাবও মুখ্যমন্ত্রী আজ দেননি। তিনি ফের দাবি করেন, রাজ্যে শিল্পস্থাপনে জমি কোনও সমস্যা নয়। ল্যান্ড ব্যাঙ্কে জমি রয়েছে। কোথায় কত জমি রয়েছে, সেই তথ্য সরকারি ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। জমি নিয়ে কোনও সমস্যা হলে তা মুখ্যসচিবকে জানানোর জন্যও বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই কথা তিনি আগেও বহু বার বলেছেন। কিন্তু ঘটনা হল, ল্যান্ড ব্যাঙ্কে ভারী শিল্প গড়ার মতো এক লপ্তে জমি নেই। সুতরাং একমাত্র উপায় জমি অধিগ্রহণ। বেসরকারি শিল্পের জন্য যা করতে মমতার ঘোর আপত্তি। এ দিনের বৈঠকেও সেই অবস্থান বদলের কোনও ইঙ্গিত তিনি দেননি। উল্টে সংসদে গিয়ে বলেছেন, জমি অধিগ্রহণে সরকারের কোনও ভূমিকা থাকা উচিত নয়।
অথচ আজকের বৈঠকেই জমি অধিগ্রহণ না হওয়ার কারণে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজ থমকে যাওয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হিন্দুস্থান কনস্ট্রাকশনের অজিত গুলাবচন্দ। এনটিপিসি-র চেয়ারম্যান অরূপ রায়চৌধুরী উল্লেখ করেছেন জমি জটে তাঁদের কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প আটকে যাওয়ার কথা। রাজ্য সরকারকেই জমি চিহ্নিত করে দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি। কিন্তু এই সব সমস্যার সমাধানের কোনও বার্তা মুখ্যমন্ত্রী দেননি।
বৈঠকে উপস্থিত এক তৃণমূল নেতার কথায়, “আমরা যে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করব না তা শিল্পপতিরা বুঝতে পেরেছেন। রাজ্যের যে নিয়ম রয়েছে তা মেনেই শিল্প স্থাপন করতে হবে শিল্পপতিদের।” |
জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন রাজ্যে নতুন করে সমস্যা হিসেবে উঠে আসছে বলে অভিযোগ শিল্পমহলের। এ প্রসঙ্গে হলদিয়া থেকে এবিজি কর্তার অপহরণ থেকে শুরু করে গত শনিবার রাতে দুর্গাপুরে জয় বালাজি গোষ্ঠীর ইস্পাত কারখানার ম্যানেজারকে বাড়িতে চড়াও হয়ে মারধর করার ঘটনার কথা বলছে তারা। যে সব ঘটনার জেরে পশ্চিমবঙ্গে আর না-ফেরার অঙ্গীকার করেছেন এবিজি-কর্তা, জয় বালাজির কর্তাও রাজ্য ছাড়ার কথা ভাবছেন। আজকের বৈঠকে সঞ্জীব গোয়েন্কা, হর্ষ নেওটিয়ারা সস্তা ও দক্ষ শ্রমিকের জন্য পশ্চিমবঙ্গ শিল্পের গন্তব্য হতে পারে বলে দাবি করলেও, এই সমস্যা মেটানোর কোনও আশ্বাস রাজ্য সরকারের কর্তারা দেননি।
ফলে রাজধানীর বুকে শিল্পপতিদের সঙ্গে মমতার বৈঠক নিছকই সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়ে থাকবে বলে যে আশঙ্কা ছিল, তাই কি শেষ পর্যন্ত সত্যি হল?
মমতা নিজে তা মানতে রাজি হননি। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বা অনুষ্ঠানের মূল পরিচালক ডেরেক ও’ব্রায়েনেরও বক্তব্য, “শিল্পপতিদের কাছে মমতা রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের চিত্রটি তুলে ধরেছেন। পাহাড় থেকে জঙ্গলমহল আজ শান্ত। স্বচ্ছ প্রশাসন,
শিল্পের জন্য সিঙ্গল উইনডো ফলে সার্বিক ভাবে বিনিয়োগের জন্য পশ্চিমবঙ্গ যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গন্তব্য সেই চিত্রটি খোদ মুখ্যমন্ত্রী তুলে ধরেছেন। আমরা আশাবাদী। আজকের এই বৈঠক ভবিষ্যতে রাজ্যে বিনিয়োগের রাস্তা খুলে দেবে।”
রাজ্য সরকারের দাবি, আজকের বৈঠকের পর ইন্ডিয়ান অয়েল আগামী পাঁচ বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। অ্যাপোলো সংস্থার পক্ষ থেকে রাজ্যে আরও একাধিক হাসপাতাল নির্মাণ, সেলের সিএমডি সি এস বর্মা বার্নপুরের ইউনিটটির ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করার প্রতিশ্রুতি দেন। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেন, “ডালমিয়া সংস্থা শালবনিতে পাঁচশো কোটি টাকায় একটি সিমেন্ট কারখানা নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।” দিল্লির পরে এই ধাঁচের একটি শিল্প বৈঠক মুম্বইতেও করার কথা ভাবছে রাজ্য সরকার।
বৈঠকে আসা শিল্পপতিরাও প্রকাশ্যে কোনও খারাপ কথা বলেননি। বরং পশ্চিমবঙ্গ যে ভাবে নিজের বিপণনে এগিয়ে এসেছে তার
প্রশংসা করেছেন ফিকি, সিআইআই-র মতো বণিকসভাগুলি ছাড়াও হিরো, ইন্ডিয়ান অয়েল, সেল বা অ্যাপোলো সংস্থার কর্ণধারেরা।
কিন্তু এ সবই নিছক সৌজন্য, বলছে শিল্পমহলের বড় অংশ। |
এই সংক্রান্ত খবর... বিতর্ক সঙ্গী করেই আজ সংসদে জমি বিল |