|
|
|
|
রাজ্য ছাড়তে চান জয় বালাজির কর্তা, অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
বিক্ষোভের নামে আধিকারিকদের হেনস্থা এবং বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করার অভিযোগে তিন স্থায়ী কর্মীকে ‘সাসপেন্ড’ করল জয় বালাজি। ওই তিন জন ছাড়া এক আইএনটিটিইউসি নেতার নামেও পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তবে শনিবার রাতে দুর্গাপুরে যাঁর বাড়িতে ঢুকে হামলা করা হয়েছিল, সেই জেনারেল ম্যানেজার অরুণ থাতৈ সোমবারও কাজে যাননি।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শ্রমিক অসন্তোষ ও তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে শিল্পে অনিশ্চয়তা আবার সামনে এল। সংস্থার আধিকারিকেরা যে এখনও নিরাপত্তার অভাবে ভুগছেন, তাতে সন্দেহ নেই। ওড়িশা থেকে আসা অরুণবাবু রবিবারই বলে দিয়েছেন, “আমার স্ত্রী ও সন্তানেরা চাইছে, শুধু এই শহর নয়, এই রাজ্য ছেড়ে অন্য কোথাও কাজ খুঁজে চলে যেতে। সে কথা আমি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছি।”
শনিবার রাতে যে ভাবে মুখ ঢাকা কিছু লোক অরুণবাবুকে তাঁর আবাসন থেকে টেনে বের করে মারধর করে, তার
|
অরুণ থাতৈ।
—নিজস্ব চিত্র |
সঙ্গে হলদিয়ায় এবিজি গোষ্ঠীর তিন আধিকারিক অপহরণের ঘটনার অনেক মিল। বিশেষ করে, দুই ক্ষেত্রেই শাসকদল তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। যদিও দুর্গাপুরের ঘটনায় সরাসরি কোনও দল বা সংগঠনের নাম করতে চাননি জয় বালাজি কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু হলদিয়ার সঙ্গে দুর্গাপুরের অমিলও রয়েছে এক জায়গায়। তৃণমূলের শ্রমিক আন্দোলনের জেরে এবিজি-কে যেখানে রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে, সোমবার জয় বালাজির তরফে জানানো হয়, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা পাওয়ায় আপাতত সমস্যা মিটেছে। স্বাভাবিক উৎপাদনও হয়েছে। হামলাকারীদের সমর্থন করার বদলে তৃণমূল তথা আইএনটিটিইউসি নেতারা বরং অভিযুক্তদের সঙ্গে ‘দূরত্ব’ বাড়াতেই ব্যস্ত। কিন্তু যে আবাসনে হামলা হয়েছিল, সেখানকার আতঙ্কিত আবাসিকেরা সিসিটিভি বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লিতে শিল্পপতিদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন তাঁর শিল্পবান্ধব ভাবমূর্তি, তখন এই ধরনের ঘটনায় নেতিবাচক বার্তাই যাচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। বিশেষত সিঙ্গুরে যাঁরা মমতার জমি আন্দোলন সামাল দিতে পারেনি, সেই সিপিএম এখন রীতিমতো আক্রমণাত্মক। এ দিন আলিমুদ্দিনে রাজ্য কমিটির বৈঠকের ফাঁকে প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন দাবি করেন, “বহু কারখানাতেই এমন ঘটনা ঘটছে। এতে বিপজ্জনক ইঙ্গিত যাচ্ছে। নতুন শিল্প আসতে ভয় পাচ্ছে।” বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মতে, “টাটা যা বলেছেন, তাতে রাজ্যে শিল্পায়নের সমস্যা সমাধানে একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বালাজির উপরেও আক্রমণ হচ্ছে। এরা (শাসকদল) নতুন কিছুই করছে না। যা আছে, তাদেরও তাড়াতে চাইছে!” দুপুরে দুর্গাপুরে সাংবাদিক বৈঠকে সিটু-র বর্ধমান জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বিনয়েন্দ্র কিশোর চক্রবর্তীমন্তব্য করেন, “হলদিয়ায় শিল্পস্তব্ধ করার ছবি আগে দেখেছি। তার ছায়া দেখতে পাচ্ছি দুর্গাপুরেও।”
শনিবার দুপুরে দুর্গাপুরের নামো সগরভাঙায় জয় বালাজির প্রায় ১ হাজার টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কারখানায় অনিয়মিত ভাবে বেতন মেলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল আইএনটিটিইউসি। রাতে জেনারেল ম্যানেজার (ইলেকট্রিক্যাল) অরুণবাবু আক্রান্ত হন। সে ক্ষেত্রে শুধু কিছু ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ লোকজনের কথা জানানো হলেও প্রথম ঘটনায় আইএনটিটিইউসি নেতা অসীম প্রামাণিক-সহ চার জনের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয়েছে।
সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট নিরঞ্জন গৌরীসারিয়ার অভিযোগ, প্রশাসনিক ভবনে বৈঠক চলাকালীন অসীমবাবুর নেতৃত্বে বেশ কিছু আইএনটিটিইউসি সমর্থক জোর করে ঘরে ঢুকে পড়েন। পরে আসতে বলা হলে উল্টে হুমকি দেন। ঘরের বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করে দেন তিন স্থায়ী কর্মী অরুণ পাল, পঞ্চানন ঘোষ ও রবিদেব আচার্য। পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়। রবিবার রাতে কোকওভেন থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়।
এ দিন ওই তিন কর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়।
আইএনটিটিইউসি নেতারা ঘটনার দায় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছেন। সংগঠনের বর্ধমান জেলা সভাপতি প্রভাত চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, অসীমবাবুদের সংগঠনকে তাঁরা অনুমোদন দেননি। নারায়ণ মণ্ডলের নেতৃত্বে বৈধ সংগঠন কাজ করছে। কিন্তু কারখানা সূত্রের খবর, দীর্ঘদিন ধরেই সেখানে তৃণমূলের দু’টি সংগঠন সক্রিয়। অসীমবাবুর প্রভাব ক্রমশ কমছে। তাই তিনি জোর খাটানোর চেষ্টা করছেন। অসীমবাবু অবশ্য পাল্টা চ্যালেঞ্জ করেন, “২০১০ সালে আমাদের সংগঠন স্থায়ী অনুমোদন পেয়েছে। আমাদের সংগঠন যদি অবৈধ হয়, প্রভাতবাবু কারখানা কর্তৃপক্ষকে লিখিত ভাবে সেটা জানাচ্ছেন না কেন?” অসীমবাবু-সহ প্রত্যেকেই অবশ্য এখন আধিকারিকের উপরে হামলার নিন্দা করছেন। কারখানার সিটু অনুমোদিত সংগঠনের সভাপতি তথা দুর্গাপুরের প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক বিপ্রেন্দু চক্রবর্তীর মতে, “আধিকারিকের উপরে হামলা যারাই করে থাক, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে রাজ্য সরকারকে। তা না হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিল্পায়নে।” দুর্গাপুরের মেয়র তথা তৃণমূল বিধায়ক অপূর্ব মুখোপাধ্যায় বলেন, “পুলিশ-প্রশাসনকে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।” আসানসোল-দুর্গাপুরের এসিপি (পূর্ব) এস সিলভান মুরুগানের দাবি, গুরুত্ব দিয়ে ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে। কিছু সূত্র মিলেছে।
‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করার এই চেষ্টায় যে কিছুটা কাজ হয়েছে, তার ইঙ্গিত মিলেছে সংস্থার অন্যতম যুগ্ম ম্যানেজিং ডিরেক্টর গৌরব জাজোদিয়ার কথায়। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের কাছ থেকে যথোপযুক্ত সহযোগিতা মেলায় সমস্যা কেটে গিয়েছে। এ দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম হয়েছে।” ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, “কিছু আধিকারিক এ দিন আসেননি। তবে কারখানার সামনে পুলিশ পিকেট বসায় তাঁরা ভরসা পাবেন।” বছর দশেক যাবৎ দুর্গাপুর বিধাননগরের একটি আবাসনে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন অরুণ থাতৈ। শনিবার রাতে গেটে থাকা বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী রোহিত দাস জানিয়েছেন, মাফলারে মুখ ঢাকা ১২-১৫ এসেছিল। কয়েক জনের হাতে লাঠি ছিল। অরুণবাবুর পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এন কে দাস বলেন, “গোলমালের শব্দ শুনে যখন বেরোই, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।” প্রবেশপথে সিসিটিভি বসানো নিয়ে আজ, মঙ্গলবার আবাসন কমিটির বৈঠকে আলোচনা হবে বলেও তিনি জানান। এর পরেও অরুণবাবু এ রাজ্যে থাকার ভরসা পাবেন কি না, তা অবশ্য এখনও অজানা। |
|
|
|
|
|