সুনীতি রোডের উপর আমার আস্তানা। সেখান থেকে রাসমেলার মাঠ বেশি দূর নয়। হাঁটছি। দু’চারটি ওষুধের প্রয়োজন ছিল। একের পর এক দোকান ঘুরছি, নেই। খুব ব্যতিক্রমী রোগের বিরল ওষুধ নয়। সামান্য ল্যাকটোব্যাসিলাস পুরিয়াই পাওয়া গেল না। এই প্রথম নয়, আগেও দেখেছি, কলকাতার ডাক্তারের প্রস্তাবিত হৃদরোগের দাওয়াই কালচিনি, হ্যামিলটনগঞ্জে পাওয়া যায়নি। অ্যান্টিবায়োটিক খুঁজতে গিয়ে বিব্রত হয়েছি এমনকী আলিপুরদুয়ার শহরে। সবাই বলে, ‘সময় দিন, শিলিগুড়ি থেকে আনিয়ে দেব।’ তার অর্থ গোটা দুইটি দিন। ইতিমধ্যে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার মন্ত্র শিখতে হবে। কোচবিহারের কাছে কিঞ্চিৎ বেশি আশা ছিল। রোগ নিরাময় ক্ষেত্র হিসেবে ডুয়ার্সের মানুষের কাছে কোচবিহার বড় ভরসার জায়গা। সেখানে, আমারই সঙ্গে, একটি জরুরি আই ড্রপ খুঁজে খুঁজে পেলেন না এক জন।
বঞ্চনার তালিকা আরও প্রলম্বিত হতে পারে। তার চেয়ে বরং আমার প্রত্যাশিত তোরণের দিকে তাকানো যাক। সুনীতি রোডের উপরেই তার দেখা মিলেছে। অল্প দূরে দূরেই বেশ কয়েকটি। ২০০ বছরের মেলার তোরণ বলে আলাদা সাজ পরেনি তারা। একেবারেই বিজ্ঞাপনী নির্মাণ। সারা গায়ে প্রচার মেখে, পণ্য হেঁকে, শিল্পের ধারেকাছে না গিয়েকেবল খাড়াই চৌকো কাঠামো। কী করা যাবে, আজ আমার প্রত্যাশা অপূরণের দিন। হয়তো আরও তোরণ আছে। পথ অন্ধকার থাকায় চোখ পড়েনি। তবে, লোকে বলে, সব আশাই ব্যর্থ হয় না। আমিও তার ফল পেলাম। মেলা প্রাঙ্গণে পা রেখেই জিলিপি-গজা-খুরমা-অমৃতির প্রাণ মাতানো গন্ধে আমার মন দিব্য আনন্দে ভরে গেল। কিছু পরেই ভ্যাটাগুড়ির জিলিপিতে কামড় দিয়ে মনে হল, আহা! এমন জিলিপি পান বলেই মদনমোহন শত শত বছর ধরে কোচবিহারে রয়ে গেছেন। |
মদনমোহন মন্দির একই রকম। সেই ছোটবেলার মতো, যেমন দেখেছিলাম সেই পুতনা রাক্ষসী, পৌরাণিক চরিত্র নিয়ে মাটির পুতুল। সদ্য রং ফেরানো মদনমোহন বাড়ি কী উজ্জ্বল! সেজেগুজে মদনমোহন ভক্তের প্রণাম ও প্রণামী দুই-ই নিচ্ছেন। স্মিত হাসিখুশি মুখে পুলিশ নজরদারি চালাচ্ছে। প্রাঙ্গণের পূর্ব প্রান্তে হাতের কাজের প্রদর্শনী। সেখানে দর্শকের সুশৃঙ্খল ভিড়। নাটমন্দিরে কীর্তনগান হচ্ছে। সুকণ্ঠী গায়িকা সুরে সুরে বলছেন
ওগো, কই তুমি?
তিনি বললেন, এই তো, এই তো আমি, তোমাদের কাছে, তোমাদের মাঝে!
কই, ওগো, আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
পাচ্ছ না?
... ... তুর তাক তাক টাক চিম টাক চিম বেজে উঠল খোল, নেচে উঠলেন বাদ্যকর, কীর্তননিধি গান ধরলেন কৃষ্ণ-ও-ও-ও-ও!
বরাবর আমার মনে হয়েছে কীর্তনগানে উচ্চগ্রাম যন্ত্র বাহুল্য। এ গানের ভক্তিবিনম্র কারুণ্য মাইকের চিৎকার স্বভাবে লোপ পায়। শুধু কীর্তনই বা কেন, আমাদের ভূমিজাত ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল ইত্যাদি সমস্তই যেন গায়কের কণ্ঠ ও শ্রোতার শ্রবণের মাঝে আর কিছু সহ্য করে না। কিন্তু আমার মতে দুনিয়াদারি চলবে কেন! কীর্তনের আসর, বড় বড় লাউড স্পিকার সমেত জমজমাট। পরের রাতে যাত্রাপালা। ভক্তিমূলক বিষয়। কেষ্টঠাকুরকে তো আর ‘সিঁদুর নিও না মুছে’ দেখানো যায় না!
মদনমোহনবাড়ির উৎসবমুখরতায় আমি একেবারে ডুবে গেলাম। রাসচক্রের চরণ ধরে এক পাক ঘুরিয়ে পুণ্যার্জন করছে লোকজন। আমিও খানিক পুণ্য আদায় করে নিলাম। বাঁশ আর কাগজে বানানো অসামান্য কারুকৃতি। এর কারুকর আলতাফ মিয়াঁর সঙ্গে দু’ দণ্ড কথা বলার বাসনা হল। কোচবিহারে আমার সাংবাদিক বন্ধু তার আয়োজন করতে লাগল। আমি মেলা ঘুরতে লাগলাম। দু’শো বছরের মেলায় এ বার বিশেষ আকর্ষণ দুটি সার্কাস। আছে মৃত্যুকূপ। ছোটবেলায় দেখা মৃত্যুকূপে হাড় হিম করে দেওয়াল বাইত মোটর বাইক আরোহী। সে ছিল অরণ্যদেবের মতো কুশলী। এখন স্পাইডারম্যানের চেয়েও বেশি দক্ষতায় তিনটে চার চাকার মোটরগাড়ি দেওয়াল বেয়ে চলে। নিখুঁত আঙ্কিক অভ্যাসে গ্রহ-উপগ্রহের মতো ঘুরতে থাকে যে যার বলয়ে। এক পল চ্যুত হলেই মৃত্যু পরিণাম। শুধুমাত্র জীবিকা এ হতে পারে না। ভয়ঙ্করের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার দুঃসাহস এই জীবিকার পাথেয়। সেই মৃত্যুকূপের বাইরে তার প্রভাব পড়ে না। সংস্কৃতি মঞ্চে গানের অনুষ্ঠান চলেছে। সার্কাসে লোক হাসাচ্ছে ক্লাউন। সগর্বে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশি ঢাকাই, শীতপোশাকের দোকানি শীতের প্রার্থনা করছে। প্যাঁ-পোঁ বাঁশি বাজাচ্ছে ছেলেমেয়ের দল। গানের তালে দুলছে শ্রোতার শরীর। ফুচকাওয়ালা মশলা মাখছে মহানন্দে। মনোহারি দোকানে মনোহরণ ভিড়। আমিও ভাবছি, বাখরখানি লুচি খুঁজব এ বার। মেলায় পাটিসাপটার গন্ধ পেয়েছি। চেখে দেখব। মৃত্যুকূপের প্রাণহন্তা খেলার জন্য শোক এক মুহূর্তের। কারণ, এই-ই জীবনের ধর্ম। সুনামি, ভূমিকম্প, আয়লা, জাতিদাঙ্গা, আতঙ্কবাদীর বিধ্বংসী বিস্ফোরণ কোনও কিছুই, অনুপদ্রুত অঞ্চলের জীবনযাপন ব্যাহত করে না। শোকের কাল লহমা মাত্র।
|