আমরি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের পরে রাজ্য জুড়ে উথাল-পাথাল হয়েছিল। বহু তদন্ত, বহু নির্দেশ, বহু সতর্কীকরণ। সরকারি হাসপাতালগুলিতে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ঢেলে সাজতে নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য দফতর। যুদ্ধকালীন তৎপরতা দেখা গিয়েছিল তখন সব জায়গাতেই।
তারপর বছর গড়িয়েছে। ভয়ঙ্কর সেই অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতিও অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। ইতিমধ্যে যুদ্ধকালীন তৎপরতার নজির বলতে কিছু চিঠি চালাচালি ছাড়া বিশেষ কিছু চোখে পড়েনি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালের চিত্রটাও কিছু ব্যতিক্রম নয়। আমরি কাণ্ডের ঠিক আগেই উলুবেড়িয়া হাসপাতালে চিকিৎসকদের বিশ্রাম কক্ষ এবং জরুরি বিভাগে দু’টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তারপরেও পরিস্থিতি শুধরোয়নি কিছুই।
এই হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা খাতা-কলমে ২৪০। তবে তিশোর বেশি রোগী প্রায় সব সময়েই থাকে। রয়েছে মহিলা ও প্রসূতি বিভাগ, সাধারণ মেডিসিন ওয়ার্ড প্রভৃতি। রয়েছে বহির্বিভাগ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভিড় উপচে পড়ে। কিন্তু অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা একেবারেই ঢিলেঢালা। |
উলুবেড়িয়া হাসপাতাল। ছবি: সুব্রত জানা। |
হাসপাতালের নীচের তলায় ওয়ার্ড মাস্টারের ঘরের পিছনে রান্না ঘর। গ্যাস জ্বালিয়ে প্রতি দিন রোগীদের জন্য রান্না হয়। সেখানে আছে একটি মাত্র আগুন নেভানোর যন্ত্র। রান্নার দায়িত্বে থাকা ঠিকাদার সংস্থা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে সেটি বসিয়েছেন বলে জানা গেল। বাকি পুরো হাসপাতালে কোথাও কোনও অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র নেই। হঠাৎ আগুন ধরলে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য হাসপাতাল চত্বরে জলের ব্যবস্থাও নেই। নেই কোনও জলের রিজার্ভার। উপরন্তু দেওয়ালে দেওয়ালে ভাঙা স্যুইচ বোর্ড, জঘন্য ওয়্যারিং যা থেকে যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
মহিলা ও প্রসূতি ওয়ার্ডের ঘর-সংলগ্ন শৌচাগারের সামনে রয়েছে মেইন স্যুইচ বক্স। সেখানেও দেখা গেল, তার খোলা। হাসপাতাল কর্মীরা জানালেন, মাঝে মধ্যেই দু’টি খোলা তার ঝুলেতে একে অন্যের সংস্পর্শে এলে আগুনের ফুলকি বেরোয়।
ভয়াবহ অবস্থা আবাসনগুলিতে। স্যুইচ বোর্ডগুলির অবস্থা খুবই খারাপ। যে কোনও মুহূর্তে শর্টসার্কিট হওয়ার মতো পরিস্থিতি। আবাসিক কর্মীরা যেখানে সেখানে হিটার জ্বালিয়ে রান্না, চা করেন। খোলা প্লাগ থেকে হিটারের সংযোগ নেওয়া হয়। কাছেই উলুবেড়িয়া দমকল কেন্দ্র। তাঁদের বক্তব্য, হাসপাতালের নিজস্ব কোনও অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থাই নেই।
তবে আমরি কাণ্ডের পরে নড়েচড়ে বসেছিল স্বাস্থ্য দফতর। দমকল বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ‘গাইড লাইন’ পাঠানো হয়। গত এক বছরে কী কী কাজ হয়েছে? |
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেল, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশ মোতাবেক হাওড়া জেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সংক্রান্ত কমিটি আমরি কাণ্ডের এক সপ্তাহের মধ্যে বৈঠকে বসেছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বিল্ডিং প্ল্যান পাঠাতে বলা হবে কমিটির কাছে। কমিটি সেই প্ল্যান পাঠাবে দমকলের পশ্চিমাঞ্চল উপ অধিকর্তার কাছে। দমকল কর্তৃপক্ষ তা দেখে জানাবে, অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত। স্বাস্থ্য দফতরের সহায়তায় সেই সুপারিশ কার্যকর করার কথা ছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসের সেই বৈঠকের পরে বিল্ডিং প্ল্যান পাঠাতে বলা হাসপাতালকে। সে সব কাজ আর বিশেষ এগোয়নি বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর।
মহকুমা হাসপাতালের সুপার তপন পালিত বলেন, “ওই কমিটির চিঠি পেয়ে আমরা বিল্ডিং প্ল্যান পাঠিয়েছিলাম। এর পরের কাজ কত দূর এগিয়েছে বলতে পারব না।” সুপারের দাবি, হাসপাতাল চত্বরে এসএনসিইউ তৈরি হচ্ছে। তার বিল্ডিং প্ল্যানও কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে।” সুপার পাশাপাশি স্বীকার করেছেন, হাসপাতালের কর্মী আবাসনে যে খোলা প্লাগ রয়েছে, সেগুলি থেকে বিপদ হতে পারে। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, “এটি পূর্ত বিভাগের দেখার কাজ। তারাই এ বিষয়ে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত।” অন্য দিকে, পূর্ত (ইলেকট্রিক্যাল) বিভাগের উলুবেড়িয়া শাখার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই বিষয়টির প্রতিবিধান করতে হবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেই। যাঁরা খোলা প্লাগ থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে হিটার জ্বালাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে হাসপাতালকে।
এই চাপানউতোরে জেরে হাসপাতালের অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুরোটাই ভাগ্যের উপরে ছেড়েছেন রোগীরা। |