অনেক লড়াইয়ের শেষে খানিকটা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু তবু আফসোস থেকে গিয়েছে চম্পকের। সেটা হল, ৫৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী হিসাবে কার্ড থাকা সত্ত্বেও কপালে জোটেনি সরকারি সাহায্য। পোলিওয় আক্রান্ত হয়ে একটা পা নষ্ট হয়ে যায়। তবে তা চম্পকের এগিয়ে যাওয়া আটকাতে পারেনি। ক্রাচে ভর দিয়ে ছোট্ট ছেলেটা বাড়ি বাড়ি ছাত্র পড়িয়ে টাকা জোগাড় করে সেই টাকায় নিজের পড়াশোনা চালিয়েছে। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছে। আয়ত্ত করেছে সোনা-রুপোর অলঙ্কার তৈরির কারিগরি বিদ্যা। আর এই হাতের কাজে মুগ্ধ হয়েই প্রতিবন্ধী জেনেও চম্পকের সঙ্গে নিজের জীবন জড়িয়ে নিয়েছিলেন লক্ষ্মী দেবী। নিজের জীবনে যে ভুল হয়েছিল নিজের সন্তানের ক্ষেত্রে তা হতে দেননি চম্পক। ছেলে সুদীপ্তকে নিয়ম মেনে পোলিও টিকাকরণে নিয়ে যান।
উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গার ঝিকড়া পঞ্চায়েতের হাদিপুর গ্রামে সখিচরণ সাহা এবং তার স্ত্রী লীলাবতীর বাড়ি। সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে মেজ চম্পক। মুদির দোকানে খাতা লেখার কাজ করে সখিচরণ সংসার চালাতেন। চম্পকের বয়স যখন মাত্র ৩ বছর, সে সময় একদিন সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে বাঁ পা অবশ ও সরু হয়ে যেতে থাকে। অনেক চিকিৎসা হলেও পা আর ভাল হয়নি। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন সময়মতো পোলিও না খাওয়া এবং টাইফয়েডের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ায় চম্পকের এই অবস্থা। |
বাবা মারা যাওয়ার পরে সংসারের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ে। শুরু হয় চম্পকের বেঁচে থাকার লড়াই। বেড়াচাঁপা দেউলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তে পড়তেই গৃহশিক্ষকতা শুরু চম্পকের। এ ভাবেই দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৮৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর মধ্যমগ্রামের দেবীগড়ে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন। এর পরে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিয়েছেন। সরকারি সাহায্যের জন্য দফতরে দফতরে ঘুরেছেন। কিন্তু কাজ জোটেনি। হতাশ না হয়ে সোনা, রুপোর অলঙ্কার তৈরির কাজ শিখতে শুরু করেন। পাঁচ বছর আগে এই কাজের সূত্র ধরেই বিয়ে। লক্ষ্মীদেবীর কথায়, “মানুষটার হাতে তৈরি নকশা বড় সুন্দর। তা দেখেই ওঁর প্রেমে পড়ে যাই।”
নিজের অবস্থার কথা জানাতে গিয়ে চম্পক বলেন, “যখন ছোট ছিলাম সে সময় আজকের মতো স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ক্লাবে পোলিও খাওয়ানোর ব্যবস্থা ছিল না। ফলে পোলিওয় আক্রান্ত হয়ে বাঁ পা সরু হতে হতে এমন অবস্থা হয় যে সেটা আর মাটি পর্যন্ত পৌঁছয় না। ক্রাচ নিয়ে চলাফেরায় অসুবিধা হত। কিন্তু মনোবল হারাইনি। খালি মনে হত, যত কষ্টই হোক কারও করুণায় নয়, নিজের জোরেই আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।”
মনের হতাশা চেপে ফের বলেন, “শুধু কষ্ট হয়, হাজার প্রতিশ্রুতি মিললেও সরকারি সাহায্য পাইনি। ভাঙড় হাসপাতাল থেকে ৫৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী বলে কার্ড দেওয়া হয়। তাতে কাজ হয়নি। বেসরকারি বাসে উঠলে প্রতিবন্ধী কার্ড থাকা সত্ত্বেও ভাড়া দিতে হয়েছে। তাই জেদ চেপে গিয়েছিল, হলই বা একটি পা বিকল, যে ভাবেই হোক নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।” |