হিংসা আর হিংসা দমনে শিক্ষার অধিকার শিকেয়
যৌথ বাহিনী নয়, স্কুল থাকবে পড়ুয়াদের দখলেই। মাওবাদী অধ্যুষিত রাজ্যগুলিকে এই স্পষ্ট নির্দেশ পাঠিয়েছে মনমোহন সরকার। কিন্তু তার পরেও জঙ্গলমহল থেকে বস্তার, সুকমা থেকে খাম্মামের মতো মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় শিক্ষার অধিকার আইন রূপায়ণ করতে গিয়ে কেন্দ্র হিমসিম খাচ্ছে। ফলে ওই সব এলাকার ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার বন্দোবস্ত করতেও নতুন করে ভাবনাচিন্তা করতে হচ্ছে সরকারকে।
মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী এম এম পল্লম রাজুও মেনে নিয়েছেন, সমস্যা অনেক। তাঁর বক্তব্য, “স্কুলগুলিতে মাওবাদীরা ভাঙচুর চালিয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা ওখানে যেতে চান না। মাওবাদী হিংসা ও যৌথ বাহিনীর অভিযানের ফলে বহু মানুষ ঘরছাড়া।” তাই কেন্দ্রের মতে, শিক্ষাকেই যদি মাওবাদী সমস্যার মোকাবিলায় অন্যতম হাতিয়ার করতে হয়, তা হলে দেশে যে পাঠ্যক্রম ধরে পড়াশোনা হচ্ছে, তার অন্ধ অনুসরণ চলবে না। পড়াশোনায় ছেদ পড়লেও শিশুরা যাতে পড়াশোনায় আগ্রহ না হারায়, তা দেখতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সঙ্গে বৃত্তিমূলক শিক্ষাতেও গুরুত্ব দিতে হবে।
দু’বছর আগে শিক্ষার অধিকার আইন এনে দেশের ছয় থেকে চোদ্দ বছর বয়সী সব বালক-বালিকার জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে সাংবিধানিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে কেন্দ্র। এ দিকে মাওবাদী দমনে রাজ্যে রাজ্যে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ায় সেখানে অধিকাংশ স্কুলেই পড়াশোনা বন্ধ। স্কুলে ঘাঁটি গাড়ে আধাসেনা। এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থের মামলাও হয়। কেন্দ্রের তরফে রাজ্যের কাছে নির্দেশ যায়, স্কুল দখলমুক্ত করা হোক। তার পরেও সব স্কুলে পড়াশোনা চালু হয়নি। সমস্যা কোথায়? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আঙুল মাওবাদীদের দিকে। হিসেব বলছে, পাঁচ বছরে মাওবাদীরা ২৬০টি স্কুল গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, বিহারে এই ধরনের ঘটনা সব থেকে বেশি। যে সব স্কুলে কেন্দ্রীয় বাহিনী ঘাঁটি গাড়েনি, সেখানেও মাওবাদীরা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। কিশোর-কিশোরীদের ল্যান্ডমাইন পুঁততে বা পুলিশের উপর নজর রাখার কাজে লাগানো হচ্ছে।
তবে মাওবাদীরা যে পড়াশোনার বিরুদ্ধে, অনেকেই তা মানতে নারাজ। ছত্তীসগঢ়ের দুর্গম এলাকা নারায়ণপুরে রামকৃষ্ণ মিশন একটি আবাসিক স্কুল চালাচ্ছে। মাওবাদীদের দুর্গ আবুঝমাঢ়ে মিশনের পরিচালনায় পাঁচটি স্কুল চলছে। মিশনের মহারাজ স্বামী বিভানন্দ বলেন, “সন্ত্রাসবাদীরা আমাদের সম্মানই করে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেখানোতেও ওদের আপত্তি নেই।” ইউনিসেফের উপদেষ্টা গীতা মেনন বলেন, “দান্তেওয়াড়ায় এক দল ছেলে আমাকে বলেছিল, মাওবাদীরা তাদের পোস্টার লাগানোর, ল্যান্ডমাইন পোঁতার দায়িত্ব দেয়। তবে যারা স্কুলে যায়, তাদের বিরক্ত করে না। যারা পড়াশোনা করে না, তাদের দিয়েই কাজ করায়।” তা হলে স্কুলবাড়িতে বিস্ফোরণ কেন? গীতাদেবীর মতে, “হতে পারে ওই সব এলাকায় স্কুলটাই একমাত্র সরকারি ভবন। তাই তারা ওটাকে নিশানা করছে।”
এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাব, মাওবাদী এলাকায় স্কুলগুলিকে ‘শান্তিপূর্ণ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হোক। সেখানে যৌথ বাহিনীও ঘাঁটি গাড়বে না। মাওবাদীরাও হামলা চালাবে না। নেপালে মাওবাদী আন্দোলনের সময়ে এমনটা হয়েছিল। ভারতে ইউনিসেফের শীর্ষকর্তা লুইস জর্জেস আর্সেনল্ট বলেন, “শান্তির অপেক্ষায় থাকলে চলবে না। তা হলে ছেলেমেয়েরা জঙ্গি-সংগঠনগুলির সহজ নিশানা হয়ে যাবে। শিশুরাও বন্দুক-গুলিতে আকৃষ্ট হয়ে যাবে।” আফগানিস্তানের উদাহরণ টেনে লুইস বলেন, নয়ের দশকে তালিবান মেয়েদের স্কুলে না পাঠানোর ফতোয়া দিয়েছিল। পরে দেখা যায়, তালিবান নেতারাই গোপনে বাড়ির মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়েছে।
এ দেশেও সাধারণ মানুষও শিক্ষার মূল্য বোঝেন বলে দাবি শিশুর অধিকার রক্ষায় তৈরি জাতীয় কমিশনের চেয়ারপার্সন শান্তা সিংহের। তাঁর মতে, “মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকার মায়েরা আমাকে বলেছেন, তারা পড়াশোনা শিখতে পারেননি। কিন্তু ছেলেমেয়েদের শেখাতে চান। কাজেই শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও স্কুলে যাওয়ার ভরসা জোগাতে হবে।” যে সব কিশোর-কিশোরী মাওবাদীদের হয়ে কাজ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে, তাদের সংশোধন কেন্দ্রে না পাঠিয়ে স্কুলে পাঠানোর পক্ষেও সওয়াল করছেন শান্তাদেবী।
প্রশ্ন ঘরছাড়াদের কী হবে? সরকারি হিসেব বলছে, ২০০৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত মাওবাদী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষে সাড়ে চার লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। এর মধ্যে ২০০৯-এর মাঝামাঝি থেকে ২০১০-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত এক লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। অসমে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে কোকরাঝাড়, চিরাং, ধুবুরি, বাকসা জেলার চারশো গ্রামের দু’লক্ষ মানুষ ঘরছাড়া হয়ে পড়েছিলেন। এখনও ত্রাণ শিবিরে যাঁরা আছেন, তাঁদের জন্য না আছে স্কুল, না অঙ্গনওয়াড়ি বা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। ফলে শুধু মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকা নয়, উত্তর-পূর্ব ও জম্মু-কাশ্মীরেও শিক্ষার অধিকার আইন রূপায়ণে সমস্যা হচ্ছে বলে মেনে নিচ্ছেন মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.