নিউ কোচবিহার স্টেশন থেকে কাছারির মোড় পর্যন্ত আসতে গিয়ে গলদঘর্ম হলেন আমার বৃদ্ধ রিকশাচালক। আমিও শীতের পোশাক হাতে গুটিয়ে রেখেছি। সন্ধ্যা নেমেছে। তবু শীত নেই। অথচ ডিসেম্বরের এই প্রথম সপ্তাহে ডুয়ার্স জুড়ে শীত এসে যাবার কথা ছিল! আজ সবই অন্য রকম। হিসেবের বাইরে। এক-একটা দিন হয় এমন। নিউ কোচবিহারে ট্রেন পৌঁছবার কথা সকাল সাড়ে ন’টায়, এল বিকেল পাঁচটায়। যা কিছু কাজের পরিকল্পনা ছিল, পণ্ড হল। ভাবছিলাম, কত বছর হল কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গে রেল বা সড়কপথে যাওয়া-আসা করছি? বছর তিরিশ। ইদানীং বাসে আসা আর হয় না। শিলিগুড়ি শহরে বা তার আশেপাশে হলে বিমানে। কিন্তু বাগডোগরা বিমানপোত থেকে কোচবিহার, কালচিনি, হাসিমারা, জয়গাঁ? ভয়ঙ্কর সে যাত্রা। মাত্র একমাস আগেই সে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। ভাঙা রাস্তা নিয়ে জীবনযাপন উত্তরবঙ্গের একরকম গা সওয়া। সরকারি অবহেলা তো আছেই, সঙ্গে ঠিকাদারি চৌর্যবৃত্তি এবং ভারী বর্ষণ মিলে উত্তরবঙ্গের পথ বন্ধুর থাকাই নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও মাদারিহাট থেকে হাসিমারা পর্যন্ত যে পথ, তা মৃত্যুফাঁদ। কোনও এক জটিল রাজনীতি তার দশা এমনই রেখেছে কয়েক বছর। পাকা সড়ক ভেঙে বড় বড় গর্ত, পাথর আর ধুলোমাটি। সড়কের সামান্য ধর্মও সেখানে রক্ষিত হয়নি। |
তারই ওপর দিয়ে চলেছে বড় মালবাহী ট্রাক থেকে সব রকম গাড়ি। এমন ভাবে দুলছে সব যেন এখুনি এ ওর ঘাড়ে এসে পড়বে। পড়েছেও। ট্রাক উল্টে পড়েছে মারুতির ওপর। তিন জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
এই সব কথাই আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল বিলম্বিত ট্রেনে বসে। তিরিশ বছরে ট্রেনের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু যুগ্ম রেলপথের কাজ তেমন ভাবে এগোয়নি। ফলে বহু স্টেশনে একটি ট্রেন থামিয়ে অগ্রাধিকারী বিবেচনায় অপর কোনও ট্রেন ছুটিয়ে দেওয়া হয়। ট্রেনের সংখ্যাও শিলিগুড়ি পর্যন্ত যত বাড়বাড়ন্ত, ডুয়ার্স অল্পই বরাত পেয়েছে। পরিষেবার কথা আর নাই বা তুললাম।
এ বারে আমার আগমনের উদ্দেশ্য কোচবিহার রাসমেলা দর্শন। খুব ছোটবেলায় এসেছিলাম। মনে আছে ভেটাগুড়ির জিলিপি, বাখরখানি লুচি আর পুতনা রাক্ষসীর কথা। এক বিশাল বপু কুদর্শন মহিলা আলুথালু চুলে না শোয়া না বসা শিশু কৃষ্ণ হাসি হাসি মুখে তার স্তনে মরণ-কামড় দিচ্ছে। দৃশ্যটি আমার তেমন পছন্দ হয়নি। দেবতাদের অপরিসীম ক্ষমতা, তবু কেন যে তাঁরা অসুর দমনে বীভৎস পথ নেন, কে জানে! এর পেট চিরে ফেললেন, তার মাথা কেটে মালা গেঁথে নিলেন। হয়তো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে অপরাপর দুর্জন হৃদয়ে ভীতি উৎপাদনের অভিপ্রায়।
যেমন হওয়ার কথা, তার কিছুই হচ্ছে না, অতএব, ভেবেছিলাম কোচবিহার নগরী সুসজ্জিত থাকবে তোরণে, আলোর মালায় ঝলমলে থাকবে, নগরে পদার্পণ মাত্র মনে হবে উৎসবকিন্তু হল বিপরীত। পথবাতিগুলি জ্বলেনি, দোকানপাটে রোজকার আটপৌরে আলো। ধোঁয়াশায় ঢেকে আছে রাজবাড়ি। অনাদরে পড়ে আছে সাগরদিঘির চৌপাশ। জনজীবনে রোজকার ব্যস্ততা। আস্তানার দিকে যেতে বৃদ্ধ রিকশাচালককে বললাম, ‘কাকা, মেলায় গিয়েছ?’
তিনি বলেন, ‘সময় কই?’
‘এ বার শীত পড়ল না এখনও!’
‘পড়বে পড়বে, এর তিন গুনা ঠান্ডা পড়বে।’
বৃদ্ধ তাঁর ত্রিকালদর্শী স্বরে আমাকে আশ্বস্ত করেন। আমিও বুঝি তাঁর দশা। জীবন তাঁকে আশা করতে শিখিয়েছে। ধৈর্য্য ধরতে শিখিয়েছে। অসংখ্য মানুষের মতো। ভারতবর্ষের, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। শীত আসবে, বৃষ্টি পড়বে, দিন ফিরবে। |