এলাকায় রয়েছে পাথরশিল্প ও বিড়িশিল্প। ওই দু’টি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের কেউ কেউ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত। আবার কাজ করার সময়ে অনেকে হাতে, পায়ে আঘাত পান। চিকিৎসার জন্য কাছাকাছি হাসপাতাল বলতে রাজগ্রাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। অথচ দশ দিন ধরে কোনও চিকিৎসক নেই মুরারই থানার ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। বর্তমানে চিকিৎসকের অভাবে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র চলছে নার্স ও ফার্মাসিস্টদের ভরসায়।
স্বাস্থ্য দফতর থেকে এক জন চিকিৎসককে পাঠানো হলেও এখনও কাজে তিনি যোগ না দেওয়ায় দূরদূরান্ত থেকে এসে রোগীদের ফিরে যেতে হচ্ছে। গর্ভবতী মা কিংবা ডায়েরিয়া বা পেটের রোগে আক্রান্ত রোগী কিংবা কীটনাশক খেয়ে ফেলা রোগীদের ক্ষেত্রে ফার্মাসিস্ট বা নার্সরা সামাল দিতে পারলেও চিকিৎসক না থাকার জন্য অবস্থার অবনতি ঘটে যাওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে রেফার করা ছাড়া অন্য পথ নেই। দশ দিন ধরে চিকিৎসকহীন রাজগ্রাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের হাল হকিকত দেখতে মঙ্গলবার সকাল ন’টা দশ নাগাদ দেখা মিলল ঝাড়খণ্ডের সীমান্ত ঘেঁষা বীরভূমের গ্রাম রুকুনপুর গ্রামের এক গৃহবধূর। চার পাঁচ দিন ধরে বাড়িতে জ্বরে ভোগার পর ওই দিন সকালে এসেছিলেন রাজগ্রাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তিনি বলেন, “চিকিৎসক নেই। জ্বর গায়ে, হাত পা ব্যথা নিয়ে এখন মুরারই ব্লক হাসপাতালে যাওয়া ছাড়া অন্য রাস্তা নেই।” এই বলে চলে গেলেন সখি মণ্ডল নামে ওই গৃহবধূ। |
ন’ টা চল্লিশ মিনিট। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বহির্বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে বিষ্ণু রাজবংশী নামে এক গৃহবধূ। কপালে আঘাতের চিহ্ন। জানা গেল তিনি বহির্বিভাগ থেকে দিন সাতেক ফার্মাসিস্ট ও নার্সদের মাধ্যমে চিকিৎসা করিয়েছিলেন।
বেলা ক্রমশ বাড়ছে। সকাল দশটা কুড়ি মিনিট নাগাদ দেখা গেল মুরারই থানার কাশিল্যা গ্রামের বাসিন্দা রবিকুল শেখ, গোঁড়সা গ্রামের বধূ কাজু রাজবংশীরা হাসপাতালের সামনে গাছের তলায় বসে রয়েছেন। দুজনেই যক্ষ্মারোগী। হাসপাতাল থেকেই ওষুধ চলছে। এখানেও সেই ফার্মাসিস্ট, ল্যাব টেকনিশিয়ান এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। হাসপাতালে আর রোগীর ভিড় নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক থাকলে এমন দৃশ্য থাকে না বলে জানালেন ফার্মাসিস্ট জগন্নাথ চক্রবর্তী। হাসপাতালের রেকর্ড বই অনুযায়ী ওই দিন পর্যন্ত বহির্বিভাগে এ বছরে ২৯ হাজার ৫০০ জন রোগীর চিকিৎসা হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে এ বছরে মাসে ৩৫০ রোগীর চিকিৎসা হয়। ন’ দিন আগে চিকিৎসক চলে যাওয়ার পর বর্তমানে গড়ে দৈনিক ১০০ জন রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা পরিষেবা পান। ১০ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসক থাকলে গড়ে দৈনিক ৪ জন রোগী ভর্তি হন। এ বছর এখনও পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে ২৭৫ জন রোগীকে অন্যত্র রেফার করা হয়েছে। করে পাঠানো হয়েছে।
এলাকার বাসিন্দা তথা রাজগ্রাম বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক গোবিন্দলাল বিশ্বাস জানান, মুরারই থানার অধীন রাজগ্রাম, গোঁড়সা, মহুরাপুর তিনটি পঞ্চায়েত এলাকা-সহ পলশা অঞ্চলের একাংশ এই হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া মুর্শিদাবাদের সুতি থানার একাংশ এবং ঝাড়খণ্ডের মহেষপুর, পাকুড় থানার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার রোগীরা ওই হাসপাতাল থেকে পরিষেবা পান। এলাকায় রয়েছে পাথর শিল্পাঞ্চল, কম বেশি ছোটোখাটো দুর্ঘটনা রোজকার ঘটনা। অথচ এহেন পরিস্থিতিতে রাজগ্রাম হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই। গোবিন্দলালবাবুর অভিযোগ, “দু’জন চিকিৎসকের অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই একজন চিকিৎসকের ভরসায় হাসপাতাল চলছে। ৪ জন নার্সের জায়গায় আছে ৩ জন নার্স। তাঁদের মধ্যে ১ জন গত অগস্ট মাস থেকে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। এখন ১ জন নার্স ও ১ জন ফার্মাসিস্ট দিয়ে হাসপাতাল চলছে।”
মুরারই ১ ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকের অধীনে রাজগ্রাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রবীর মাড্ডি বলেন, “দুজনের জায়গায় একজন চিকিৎসকই দীর্ঘদিন ধরে এখানে নিয়োগ আছে। একজন চিকিৎসক কাজ ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। ওই জায়গায় নতুন করে কোনও চিকিৎসক এখনও যোগ দেননি। আপাতত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য মুরারই গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে ২ জনকে অস্থায়ী ভাবে নিয়োগ করা হয়েছে।”
স্বাস্থ্য কেন্দ্রের নার্স মৌসুমি সাহা, ফার্মাসিস্ট জগন্নাথ চক্রবর্তীরা বলেন, “চিকিৎসক নেই। কোনও রকমে ঠেকা দিয়ে কাজ চলছে। সে জন্য মাঝে মধ্যে রোগীদের গালিগালাজ খেতেও হচ্ছে। এ ভাবে আর কত দিন চলবে জানা নেই।”
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অরুণলাল মণ্ডল বলেন, “রাজগ্রাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সত্যিই রোগীর চাপ আছে। অবিলম্বে দু’জন চিকিৎসক দরকার। এই সপ্তাহেই এক জন চিকিৎসকের যোগ দেওয়ার কথা। আপাতত আগে একজন চিকিৎসক হাসপাতালে যোগদিন। পরে আরও একজন চিকিৎসককে ওখানে দেওয়া হবে।” |