বিদ্রোহের শিখা নেভাতে শাস্তির ফতোয়া
|
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
দলে বিদ্রোহের আগুনে জল ঢালতে চৌরঙ্গির বিধায়ক শিখা মিত্রকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নিল তৃণমূল। দলীয় নেতৃত্বের কাজকর্মের বিরুদ্ধে ইদানীং সরব হয়েছেন শিখাদেবী। বিধানসভায় বাম শিবিরের এক মহিলা বিধায়কের নিগৃহীতা হওয়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে বুধবারও প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেছেন, আইনসভায় থাকতে তিনি নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। আর এ সবের জেরেই দল-বিরোধী কাজের অভিযোগে তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। বিধায়ক শিখাদেবী যে হেতু দলীয় সাংসদ সোমেন মিত্রের স্ত্রী, তাই এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক অভিঘাত আরও বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে শিখাদেবীর সাসপেনশন কত দিনের বা এই সংক্রান্ত কোনও প্রশ্নেই তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কেউ মুখ খুলতে চাননি। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেছেন, “দলের অন্দরের ঘটনা নিয়ে আমি বাইরে কিছু বলব না।”
শিখাদেবীর মতোই সিঙ্গুরের রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, হলদিয়ার শিউলি সাহা, রাসবিহারীর শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় সাম্প্রতিক কালে নানা বিষয়ে দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে প্রকাশ্যেই ভিন্নমত ব্যক্ত করেছেন। বাকি তিন জনের ক্ষেত্রে দল এখনও পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু বিধায়কদের মারামারির ঘটনা নিয়ে বুধবার বিধানসভা চত্বরে দাঁড়িয়ে শিখাদেবীর মন্তব্যে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিখাদেবী এ দিন বলেছিলেন, “যে দলই করুক না কেন, বিধানসভায় ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। যে ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে, বিধানসভায় থাকা যাচ্ছে না। আমি ভয় পাচ্ছি! বিধানসভার এই রকম অবস্থা হলে বাইরের লোকজন কী ভাববেন!” তৃণমূল সূত্রের খবর, মহাকরণে বসে টিভিতে শিখাদেবীর বক্তব্য শুনেই দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন মমতা। তার পরেই শিখাকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে ঘোষণা করা নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব রাত পর্যন্ত ধোঁয়াশা বজায় রেখেছেন। |
বিধানসভায় শিখা মিত্র। —নিজস্ব চিত্র |
শিখাদেবী অবশ্য সংবাদমাধ্যমের কাছে খবর শুনে স্পষ্ট বলেন, “যা বলার, চিঠি পাওয়ার পরে বলব। আমারও অনেক কিছু বলার আছে।” প্রশ্নের জবাবে তাঁর আরও বক্তব্য, “আমার বিচার করবে জনগণ। যাঁরা আমায় ভোটে জিতিয়েছেন। কারও কাছে নাকে খত দিয়ে আমি রাজনীতি করতে আসিনি! আমি কারও চাকর নই। কারও তালিবানি ফতোয়াও
মেনে চলতে পারব না!” যোগাযোগ করা হলে সোমেনবাবুর প্রতিক্রিয়া, “আমি দিল্লিতে আছি। টিভিতে দেখলাম। দল যদি কাউকে অভিযুক্ত মনে করে, তবে তাঁকে চিঠি দিয়ে জানাবে নিশ্চয়ই। আর যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর যদি কিছু বলার থাকে তিনি দলীয় নেতৃত্বকে বলবেন।”
বস্তুত, সোমেনবাবুকে কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে শিখাদেবীর অবদান অনেকটাই। সোমেনবাবু কংগ্রেস ছাড়ার পরে তাঁর তৎকালীন শিয়ালদহ কেন্দ্র থেকে উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে বিধানসভায় পা রেখেছিলেন শিখাদেবী গত বছর তিনি অবশ্য চৌরঙ্গি কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হন। ইদানীং শিখাদেবীর সঙ্গে মধ্য কলকাতায় দলেরই কয়েক জন সোমেন-বিরোধী জনপ্রতিনিধি ও নেতার সংঘাত চলছিলই। গত ১ জুলাই প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের জন্মদিন ও তিরোধান দিবসে এক অনুষ্ঠানে শিখাদেবীর অংশগ্রহণ নিয়ে ক্ষুব্ধ হন মমতা-সহ দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এমনকী, পার্থবাবুর মন্তব্যের বিরুদ্ধে শিখাদেবী আদালতে মামলাও দায়ের করেছেন। ঘটনাচক্রে, এ দিনই সেই মামলার শুনানি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুনানি পিছিয়েছে।
শিখাদেবীর সাসপেনশন দলে অন্য বিদ্রোহীদের জন্য নেতৃত্বের তরফে সতর্ক-বার্তা বলেই মনে করছে তৃণমূলের একাংশ। তবে ওই নেতাদের কয়েক জনের আশঙ্কা, বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে দলে আরও বিশৃঙ্খলা না তৈরি হয়! বিরোধী শিবিরও প্রত্যাশিত ভাবেই শিখা-অস্ত্র হাতে তুলে নিতে নেমে পড়েছে। রেল প্রতিমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, “এটা শেষের শুরু। পশ্চিমবঙ্গে যে নৈরাজ্য চলছে, তা আরও এক বার প্রমাণিত হল। যিনি নেত্রী, তিনি ঠিক করে দেবেন কার কতটা লক্ষ্মণরেখা। এ ভাবে গণতন্ত্র চলে না!” সিপিএমের প্রবীণ বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার মতে, “শিখাদেবী ওঁর অনুভূতিতে যা বলেছেন, যে কাজ করছেন, তাতে জনগণের সমর্থন পাবেন।” বিজেপি নেতা তথাগত রায় বলেছেন, “শিখাদেবীর বক্তব্য বিবেকের প্রকাশ বলে মনে হচ্ছে।” আর তৃণমূলের বিদ্রোহী সাংসদ কবীর সুমনের কথায়, “বিধানসভায় যা ঘটেছে তা তো সত্যিই ভয়ঙ্কর! দলের উচিত ছিল শিখা মিত্র মহোদয়াকে সান্ত্বনা দেওয়া। তা না করে সাসপেন্ড! অকারণ যুদ্ধং দেহি ভাব!” |