খুব অল্প মানুষ সম্বন্ধেই এই বিশেষণ সুপ্রযুক্ত।
আমরা কি আরও দরিদ্র হলাম?
কিছু বিশিষ্ট বাঙালির সঙ্গে কথা বলেছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় |
একটাই বাক্য।— খুব অল্প কয়েক জন মানুষ ছিলেন, যাঁদের সম্পর্কে ‘স্বনামধন্য’ শব্দটা নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করা যায়— রবিশঙ্করের মৃত্যুতে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় এই কথাটা লিখেছেন অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।
রবিশঙ্করের প্রয়াণ ধ্রুপদী সঙ্গীতে কতটা শূন্যতা তৈরি করল, ভারতীয় সঙ্গীতকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা কতখানি— এ সব নিয়ে আলাপ-আলোচনার পাশাপাশি উঠে এসেছে এক অনির্বায বিলাপ! রবিশঙ্কর নেই— আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী বাঙালির ক্রমক্ষীয়মাণ তালিকা থেকে আরও একটা নাম বিদায় নিল। অভিজিৎ বিনায়কের কথাতেও সেই বিষাদেরই ইঙ্গিত!
বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহ বলছিলেন— উদয়শঙ্কর, রবিশঙ্কর, সত্যজিৎ রায়েরা যে সময়ের মানুষ, সেই সময়টাই কিন্তু সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, অমর্ত্য সেনদেরও জন্ম দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ থেকে জগদীশচন্দ্র বসু, এঁদেরই পূর্বসূরি। বঙ্গীয় রেনেসাঁসের শেষ লগ্নের প্রতিনিধি এঁরা। তখন গুণের কদর ছিল, গুণীর সান্নিধ্যে এসে নিজেদের সমৃদ্ধ করার চল ছিল। আদর্শ আর কর্মযোগ মিলেমিশে একটা অন্য সামাজিক পরিধি তৈরি করেছিল। সেটা মানুষকে দেশের জন্য কিছু করে দেখাতে উদ্বুদ্ধ করত।
এখন সে সমাজও নেই, সে প্রণোদনাও নেই স্বভাবতই। সৃজনশীলতার বিচ্ছুরণের জন্য বাতাবরণের একটা ভূমিকা থাকেই। “এখন ও রকম ক্লাসিকাল আবহ পাওয়া দুষ্কর”, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গলায় একই আক্ষেপ। |
“উদয়শঙ্কর, আলাউদ্দিন খান সাহেবকে শিক্ষক হিসেবে পেলে একটা মানুষ এমনিই অন্যদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে থাকে!” তার উপরে নিজস্ব ক্ষমতার ধার তো আছেই। ‘অপুর সংসার’-এর মিউজিক রেকর্ডিংয়ে বেশ অনেকটা সময় জুড়ে উপস্থিত থাকতেন সৌমিত্র। সামনে থেকে কাজ দেখতেন। সিনেমা, অভিনয়, সাহিত্য, নাটক সব কিছু নিয়েই রবিশঙ্করের অসীম আগ্রহ ছিল। সৌমিত্রর মনে আছে, ‘‘নামজীবন’ নাটক দেখার পরে বলেছিলেন, চলো একসঙ্গে কিছু করি।” সেটা শেষ অবধি হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ভাল কাজ দেখে মেতে ওঠার মনটা থেকে গিয়েছিল। সত্যজিৎ রায় বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হলেই ভাল বাংলা বই পড়তে চাইতেন!
নানা বিষয়ে আগ্রহ, নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা, ক্রমাগত ভিন্নতর উচ্চতার অন্বেষণ— বৃহতের যা কিছু অভিজ্ঞান, রবিশঙ্করের মধ্যে তা পূর্ণমাত্রায় দেখা যেত। জাতীয় গ্রন্থাগারের অধিকর্তা স্বপন চক্রবর্তী মনে করিয়ে দিলেন, তিনি পুরোদস্তুর পারফর্মিং আর্টিস্ট। শুধু বিরাট শিল্পী নন, পাশাপাশি পশ্চিমী কনসার্টে নিজেকে জানান দেওয়া, সংবাদ মাধ্যমের সামনে নিজেকে উপস্থাপনের দারুণ ক্ষমতা ওঁর ছিল। বিকাশ সিংহের স্মৃতিতে আছে, “বিলেতে পড়ার সময় দেখেছি, রবিশঙ্করের কনসার্ট নিয়ে ওখানে কী উত্তেজনা!”
ধ্রুপদী সঙ্গীতের মানুষ রক-পপের আবহেও দিব্যি মানিয়ে নিচ্ছেন! আবার ‘রবিবাবু’ বলে ডাকলে আর পাঁচটা নিখাদ বাঙালির মতোই খুশি হয়ে উঠছেন! এই আন্তর্জাতিক মনটা কি হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির? ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী সেটা মেনে নিয়েই বলছেন, কোনও জাতির জীবন সব সময় একই রকম সূর্যালোকিত থাকে না। এক-একটা সময় আসে, যখন একসঙ্গে অনেক মহৎ প্রতিভার জন্ম হয়। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত একটা ব্যতিক্রমী ঘটনাই।
স্বপনবাবু ধরিয়ে দিলেন, লেখাপড়ার কাজটা কিন্তু নিভৃতের কাজ, অনেকে মিলে করার কাজ। তার সঙ্গে শিল্পসাহিত্যের তুলনা চলে না। অশোক সেনের মতো পদার্থবিদ আছেন, আছেন মলয় ঘোষের মতো পরিসংখ্যানবিদ। সাধারণের গোচরে এঁদের কথা আসে না। গায়ত্রী স্পিভাককে নিয়ে এখানে হইচই হয়েছে অনেক পরে। “অমর্ত্য সেন যখন তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভাল লেখাগুলো লিখছিলেন, তখন কিন্তু তাঁর এই খ্যাতি ছিল না।” তপনবাবুরও বক্তব্য, “লেখাপড়া-শিল্পসাহিত্যে বাঙালির অবনতি হয়েছে, এ কথা বলব না। তবে মহৎ প্রতিভা অবশ্যই নতুন করে চোখে পড়ছে না।”
মধ্যমেধার রাজত্বে মহতের সম্ভারটা আর একটু দরিদ্র হয়ে গেল। |