বিদেশে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রধান দূত ছিলেন তিনি। কিন্তু সেই শ্রোতার
মনোরঞ্জনে নিজের শিকড় বিস্মৃত হননি। তাঁর প্রতিভার সবচেয়ে বড় দিক ছিল সমন্বয়।
শীর্ষেন্দু চক্রবর্তী |
অনেকেই মনে করেন, পাশ্চাত্য দুনিয়ায় রবিশঙ্করের বিরাট পরিচিতির ফলেই সংগীতকার হিসেবে তাঁর মূল্য অনেকখানি বর্ধিত হয়ে গিয়েছিল। এ কথা ঠিক যে বিদেশে ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের প্রধান দূত ছিলেন তিনিই। পশ্চিম দুনিয়া থেকে তিনি কনসার্ট-এর ধ্বনিপ্রক্ষেপণবিদ্যা বিষয়ে অনেক শিখেছিলেন, তা-ও সত্য। কিন্তু পাশ্চাত্য বিশ্বের কদরই তাঁর বিপুল খ্যাতির প্রধান হেতু— এমন ভাবনার মধ্যে আসলে লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক ঔপনিবেশিকতাবাদ, যার থেকে শত চেষ্টাতেও আমরা বেরোতে পারি না। স্বাধীনতার পর বহু দশক কেটে গেলেও এই চোরা ঔপনিবেশিকতার স্রোত বইছে এখনও।
পশ্চিমী শ্রোতাদের পছন্দের কথা ভেবে রবিশঙ্কর ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতকে কি কোনও ভাবে লঘু করেছেন, তার মধ্যে কোনও পরিবর্তন এনেছেন? মার্কিন দেশের ‘দোদুল্যমান ষাটের দশক’ কিংবা হিপি প্রজন্ম তাঁকে গুরু মেনেছিল। কিন্তু এত সত্ত্বেও কখনও কোনও শস্তা জনপ্রিয়তার ফাঁদে পড়তে দেখা যায়নি তাঁকে। আন্দ্রে প্রেভিন বা ইহুদি মেনুহিন-এর সঙ্গে তাঁর একত্র সংগীত-সৃষ্টি খুব একটা সাফল্য লাভ করেনি। আসলে মানুষটি মানসিক গঠনের দিক দিয়ে, এবং তালিম বা প্রশিক্ষণের দিক দিয়ে এই মিশ্রণজাতীয় ‘ফিউশন’ সংগীতে সম্পূর্ণতই অক্ষম ছিলেন। এই সব পরীক্ষামূলক সংগীতের মধ্যে যেটুকু তাঁর একক অংশ, সেটা মন দিয়ে শুনলেই বোঝা যায়, বিশুদ্ধ রাগ ও ঐতিহ্যবাহী ঘরানায় কতখানি মগ্ন ছিলেন তিনি। বিদেশের পপ ফেস্টিভ্যাল-এ রেকর্ড করা একটি এল-পি’তে তাঁর ভীমপলশ্রী শুনে চমকে উঠেছিলাম, সেই অবিস্মরণীয় আলাপ, সমন্বয় আর বিশুদ্ধতার সেই আশ্চর্য নিদর্শন। |
সমন্বয়। রবিশঙ্করের সংগীত-প্রতিভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক বোধ হয় এটাই। বিস্তার, গতকারি, তান-এর সুঠাম বুনোটে যে অসামান্য ভারসাম্য রেখে চলেন তিনি, তাতেই ধরা পড়ে এই সমন্বয়গুণ। অনেকগুলো দশক আগে, বিখ্যাত তবলাবাদক হীরেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায় আয়োজিত এক বৈঠকে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। মনে পড়ে, হীরুবাবু কেমন মজার ছলে রবিশঙ্করের সংগীতের বৈশিষ্ট্যের সন্ধান করছিলেন তাঁর নামের মধ্যে, সুর-মূর্ছনায় তিনি ‘রবি’-সমান, আর ছন্দে ‘শঙ্কর’ অর্থাৎ নটরাজ। সুর আর লয়, সংগীতের এই প্রধান দু’টি বিষয়ে তাঁর আশ্চর্য প্রতিভা বুঝিয়ে দিয়েছে যে, রবিশঙ্করের বৌদ্ধিক সত্তাটি জুড়ে ছিল সংগীত, কেবলই সংগীত।
রবিশঙ্করের ব্যক্তিজীবন নিয়ে দীর্ঘ কাল যাবৎ মানুষের বিপুল আগ্রহ, কিন্তু তিনি নিজের শিল্পী-সত্তাকে তাঁর ব্যক্তিজীবন থেকে যে ভাবে স্বতন্ত্র রাখতে পেরেছিলেন, সেটা অসামান্য। তিনি যখন মঞ্চে উঠতেন, তখন পিছনে ফেলে আসতেন তাঁর ব্যক্তিগত দৈনন্দিনের সব কিছুকেই। প্রসঙ্গত, তিনি নিজে কোথাও একটা লিখেছিলেন, আগেকার ঘরোয়া আসরে শ্রোতাদের ‘কাছাকাছি’ থাকার যে রীতি ছিল, আধুনিক কনসার্ট হলের রীতিটা তার থেকে আলাদা। সেখানে প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার, শিল্পী শ্রোতাদের দেখতে পান না। রবিশঙ্কর বলেছিলেন, এই দূরত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা তাঁকে নিজের চেতনায় অবগাহনের সুযোগ দেয়, যে সুযোগ আগে পাওয়া যেত না। একক শিল্পীর সত্তাটি তাঁর এই কথায় বড় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কী ধরনের শ্রোতৃসমাজকে খুঁজত রবিশঙ্করের বাজনা? এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের সমাজতত্ত্বে একটা বড় পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে হয়। আমাদের ভাবতে হয়, কী ভাবে এই সংগীত রাজ-অনুগ্রহ ছাড়িয়ে বেরিয়ে এসেছিল। উচ্চমার্গবিহারী পৃষ্ঠপোষকদের ঘনিষ্ঠ সংবদ্ধতা ছাড়িয়ে বহু-ভাষী বহু-ভাব-অধ্যুষিত শ্রোতৃসমাজের কাছে পৌঁছেছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান চ্যালেঞ্জ দাঁড়ায় কোনও রকম সাংগীতিক সমঝোতা না করেই গজল কিংবা ভজন ‘ককটেল’-এ অধ্যুষিত এই নতুন শ্রোতৃসমাজকে সঙ্ঘবদ্ধ করা। এই জায়গাটাতেই রবিশঙ্কর নিজের জন্য একেবারে মধ্যমঞ্চে স্থান করে নিয়েছিলেন। কোনও বিশেষ গোষ্ঠী বা ব্যক্তির কথা না ভেবে সকলের জন্য সংগীতকে খুলে দিতে পারতেন তিনি। অর্থাৎ যদিও তাঁর মধ্যে চিরদিনই চলমান থাকত আদর্শ শ্রোতার সন্ধান, তবু আশ্চর্য ভাবে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিপুষ্ট মানুষ, পরস্পরবিরুদ্ধ রাজনৈতিক বৃত্ত এবং ধর্মীয় বিশ্বাসকে এক জায়গায় এনে ফেলতে সক্ষম হয়েছে তাঁর সংগীত।
কী ভাবে কোনও বিশেষ শ্রোতার কথা মাথায় না রেখে সেতার বাজাতে বসতেন মানুষটি, তার এক দৃষ্টান্ত মনে পড়ে। চার-পাঁচ দশক আগে দিল্লির মডার্ন স্কুল প্রাঙ্গণে বাবা আলাউদ্দিন খানের স্মরণে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান। সামনে কিছু চেয়ার রয়েছে, তবে অধিকাংশ শ্রোতার জন্যই চতুর্দিকে কার্পেট বিছানো। বন্ধুদের সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে গিয়েছি আমি, ভাল আসন পাওয়ার আশায়। মানুষের ঢল নামতে শুরু করল কিছু পরেই, দেখলাম তাঁদের অনেকেই সঙ্গে বইছেন হাওয়া-ভরা বালিশ, এমনকী ফোমের তোশক সারা রাতব্যাপী একক অনুষ্ঠান বলে কথা! এক জনকে দেখলাম, ঘুমের বন্দোবস্ত আরও পাকা, পাশের লোকটিকে তবলা শুরু হলেই জাগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। রবিশঙ্কর এলেন, এই বিচিত্রধর্মী শ্রোতৃসমাগম বিষয়ে কোনও হেলদোল না দেখিয়েই বাজাতে শুরু করলেন ঝিঁঝোটি রাগ। তাঁর এই অটল মনঃসংযোগকে অনেকেই মনে করতেন অসাধারণ, অনুকরণযোগ্য পেশাদারিত্ব। কোনও মেজাজ নেই, সব সময় শোভন, শ্রী-ময়, আন্তরিক; মধ্যবিত্ত-সমাজে শিল্পী বলতে যে সদাবিক্ষুব্ধ খামখেয়ালি জিনিয়াস-এর ছবিটি ভাবা হয়, কোনও সাদৃশ্যই নেই তার সঙ্গে। মহান শিল্পীদের অনেকেই মেজাজি, এ কথা ঠিক। তবু এ-ও ঠিক যে, জন্মগত খামখেয়ালিপনা কিন্তু শৈল্পিক নৈপুণ্যের জন্য পর্যাপ্ত বা আবশ্যিক, কোনও শর্তই নয়। যা হোক, পেশাদারিত্ব বলতে যদি বাজারি অর্থে ক্রয়-বিক্রয়ের চেতনা বোঝায়, তবে কিন্তু এই শব্দটিও তাঁর ক্ষেত্রে খাটে না। তিনি তাঁর শ্রোতাদের মূল্য দিতেন, সন্দেহ নেই। তবে তাঁর ক্ষেত্রে আসলে শিল্পীর পেশাদারিত্ব এবং শিল্পীর ঐকান্তিকতার মধ্যে কোনও তফাত ছিল না। শিল্পের ফর্ম-এর ক্ষেত্রে তাঁর কমিটমেন্ট-এর পরিমাণ বোঝা যেত তাঁর চিরকালীন গুণ সমায়ানুবর্তিতা থেকেও কোথায় শুরু করতে হবে, আর কোথায় শেষ করতে হবে, অব্যর্থ ভাবে জানতেন তিনি।
তাঁর সংগীত-ভাবনার দুনিয়ায় কোনও অন্ধকার কুঠুরি ছিল না, এলোমেলো ছবি ছিল না, সব দিকই সম ভাবে আলোকিত। আলাপ শুরু হওয়ার পর আস্তে আস্তে এক অংশের সঙ্গে মিশে যেত পরের অংশ, আর তাঁর সেতার যেন অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে আলো ফেলতে ফেলতে আমাদের নিয়ে যেত গভীরে থেকে আরও গভীরে। রাগের এই ক্রম-উন্মোচনকারী সত্তাটির উপর তাঁর এই দৃঢ় দখলের জন্যই তিনি অন্য সব সমসাময়িক প্রতিভার থেকে আলাদা। বিস্তার-এ যেমন রাগের প্রকৃত স্বরূপটি বিকশিত হয়ে ওঠে, তাঁর ধৈর্যময়, সুসংবদ্ধ, পরস্পর-সমন্বিত স্টাইলের জন্য আলাপ-ও ঠিক তেমন ভাবেই শ্রোতৃ-মনে ধীরে কিন্তু অভ্রান্ত পূর্ণতায় বিকশিত হয়ে উঠত।
রবিশঙ্করের স্টাইলের এই সহজতার জন্যেই তীক্ষণধী শিল্পীর বাজনা শেষ অবধি পূর্ণতার শান্তি ছড়িয়ে দিতে পারত অনায়াসে। স্ফটিকের মতো এই সুসংস্থিত শান্তি হয়তো বুঝিয়ে দেয় পশ্চিমি শ্রোতারা কী বোঝেন ‘কাথারসিস’ বলতে, কিংবা আমাদের শাস্ত্রে ‘রস’-এর জটিল ধারণাটির রূপ আসলে কেমন। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের নানা ওলটপালটের প্রেক্ষিতে যদি স্থাপন করা যায় এই রাগাশ্রিত শান্তির ছবিটি, বেরিয়ে আসে একটা অন্য গুরুতর কথা। স্বাধীন ভারতের বহুসংকট-দীর্ণ পরিস্থিতিতে আধুনিক শিল্পীর প্রবণতাই হল এই সব সংকটকে বিক্ষত নৈকট্য থেকে ধরতে চাওয়া। আর তার থেকেই তৈরি হয়ে গেল একটা ঝোঁক, সুচিন্তিত আত্মপ্রকাশের বদলে তাৎক্ষণিক তরঙ্গহিল্লোল তোলার দিকে শিল্প-আঙ্গিকের ঝোঁক। এ কথা সত্যি যে বাস্তবের ঘূর্ণির মধ্যে পূর্ণ আত্মনিমজ্জন ছাড়া শিল্প অসম্ভব। তার সঙ্গে এও সত্যি, আবার উপরিতলে ভেসে ওঠাও জরুরি, বিশ্বপৃথিবীর সঙ্গে সেই ঘূর্ণির অতল গভীরের পরিচয় করানোর জন্য। প্রকাশভঙ্গির মধ্যে একটা দূরত্বমিশ্রিত প্রশান্তি না থাকলে এই কাজটা সম্ভব নয়। এখানেই ছিল রবিশঙ্করের সহজতা ও প্রশান্তির জোর, অন্তর্দর্শন ও আত্মজিজ্ঞাসার পথে তাঁর এগিয়ে যাওয়ার পাথেয়।
|
দ্য টেলিগ্রাফ (১৫ অগস্ট, ১৯৯৭) পত্রিকা থেকে নির্বাচিত অংশের ভিত্তিতে। |