মেয়েদের পোশাক কেমন হইবে, তাহা লইয়া সমাজের মাথাব্যথার অন্ত নাই। প্রতিদিনই ভারতের কোথাও-না-কোথাও এ ব্যাপারে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণ জারি হইয়া চলিয়াছে। উত্তরপ্রদেশের বিজনৌর জেলায় জেলাশাসক সারিকা মোহন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশপ্রসাদ যাদবের একটি চেক-বিতরণের অনুষ্ঠানে প্রাপক মহিলাদের কালো পোশাক পরিয়া আসিতে নিষেধ করিয়া দেন। সেই সঙ্গে জিনস বা টি-শার্ট-এর মতো পোশাকও নিষিদ্ধ হয়। মুখ্যমন্ত্রী নিজে অবশ্য কালো জহরকোট পরিয়াই চেক বিলি করেন। হরিয়ানার একটি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আবার জিনস ও টি-শার্ট পরিয়া আসা ছাত্রীদের পোশাক-বিধি ভঙ্গ করার দায়ে জরিমানা করেন। উভয় ক্ষেত্রেই এই কানুনি নিষেধের অজুহাত থাকিয়াছে পোশাক হইতে ছড়াইয়া পড়া প্ররোচনা। এই ধরনের পোশাক নাকি পুরুষদের উত্তেজিত করিয়া মহিলাদের শ্লীলতাহানিতে উস্কানি দেয়।
মেয়েদের পোশাক সম্পর্কে এই স্পর্শকাতরতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সাবেক মূল্যবোধের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ। পুরুষ নিষ্পাপ, নারীর উত্তেজক, খোলামেলা পোশাকই তাহাকে উত্তেজিত, ভ্রষ্ট, নষ্ট করিয়া দেয় তাত্ত্বিক ভাবে ইহা প্রতিষ্ঠা করিতে পারিলে অপরাধী পুরুষের কঠোর শাস্তির প্রসঙ্গটি গৌণ, এমনকী অবান্তর হইয়া উঠে। অতএব মেয়েদের আপাদমস্তক বস্ত্রাবৃত করিয়া কাপড়ের কারাগারে বন্দি করিয়া ফেলা হউক। বোরখা, হিজাব ইত্যাদি আবরণীর বন্দোবস্ত দ্বারাই হউক, বা ‘শোভনসুন্দর’, ‘রুচিসম্মত’ পোশাকের দ্বারাই হউক, কোন উপায়ে মহিলাদের যথেষ্ট আবৃত করা যাইবে, তাহাই পুরুষতন্ত্রের এক ঐতিহ্যসম্মত চিন্তা। সবচেয়ে বড় কথা, মেয়েরা কী পোশাক পরিবেন, সেটা তাঁহারা নিজেরা নয়, তাঁহাদের হইয়া সমাজ নির্ধারণ করিয়া দিক। সেই সমাজ তথা কর্তৃপক্ষ ঘটনাচক্রে অর্থাৎ ব্যক্তিগত স্তরে নারী হইতেই পারেন। কিন্তু ফতোয়া জারির সময় তিনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সনাতন মূল্যবোধের রক্ষক ও অভিভাবক।
ভারতীয় পিতৃতন্ত্রের সনাতন মূল্যবোধে কি নারীর পোশাক লইয়া কোনও ছুৎমার্গ ছিল? অন্তত হিন্দু দেবদেবীর মন্দির-ভাস্কর্যে চোখ বুলাইলে তাহা মনে হয় না। প্রাচীন সংস্কৃত কাব্যে, কালিদাস-মাঘ-ভাস-এর রচনায় স্খলিতবসনা নায়িকাদের বর্ণনা অফুরন্ত, অজন্তার গুহাচিত্রে, রাজপুত ও কাংড়া চিত্রকলায় নারীপ্রতিমার অনুপম দেহবল্লরীর উদ্যাপন, তাহার সৌন্দর্য আস্বাদনের যোগ্যতা যে একবিংশ শতকের এই ফতোয়াবাজদের থাকিবে না, তাহা নিশ্চিত। পোশাকের পুরাতত্ত্ব ঘাঁটিলেও বুঝা যাইবে, কাহাকেও প্রলুব্ধ কিংবা বিমুখ করিতে উহা পরিহিত হয় না, পরা হয় আরামের জন্য এবং সেই ন্যূনতম প্রয়োজন মিটিয়া গেলে সৌন্দর্যচেতনা বা ফ্যাশন-সচেতনতা হইতেও তাহার বিবর্তন ঘটে। যাঁহারা মেয়েদের খোলামেলা পোশাককে শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের কারণ রূপে শনাক্ত করেন, তাঁহাদের দৃষ্টি বিকৃত, মানসিক গঠনও কলুষিত। তাঁহাদের চোখের ডাক্তার ও মনের ডাক্তার দেখানো দরকার। জিনস-টি-শার্ট পরেন না, এমন মেয়েরাও গোটা দেশে পুরুষের রিরংসার শিকার হইতেছেন, মনে পড়ে কি? |