সম্পাদকীয় ১...
বিশ্বনাগরিক
বাঙালির ধর্ম হইল কূপে বাস করিয়া সমুদ্রের নিন্দা রটানো। আবার, একই সঙ্গে, কেন তাহাকে সমুদ্রপ্রাণীরা আসিয়া কূপ হইতে তুলিয়া লইয়া যায় নাই তরঙ্গের সম্বর্ধনাপ্রান্তে, তাহা লইয়া অভিমান রচনা। নিজ অক্ষমতার কার্য-কারণ কষিয়া ওষ্ঠ ফুলাইয়া সে কালাতিপাত করে এবং নানা বর্ণ ও আকৃতির ক্ষোভ লইয়া লোফালুফি সারে। এই স্বনির্মিত ক্ষুদ্রতার গড়ন ও ধরন সচেতন ভাবে চূর্ণ করিয়া যে অল্পসংখ্যক বাঙালি বিশ্বের মঞ্চে মস্তক উচ্চে তুলিয়া দাঁড়াইয়াছেন ও পরাক্রমের সহিত আন্তর্জাতিক সম্মান আদায় করিয়া লইয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে উজ্জ্বলতর রবিশঙ্কর। প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে তাঁহার সমান অনায়াস শার্দূলসঞ্চার, দুই গোলার্ধে তাঁহার সমান উত্তাল যশ। পাশ্চাত্যে তিনি ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের মুখ। ভারতে তিনি পাশ্চাত্যের জৌলুসপ্রাপ্ত তারকা। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রতি তিনি আজীবন প্রণত ও শ্রদ্ধাবান থাকিয়াছেন, একই সঙ্গে পাশ্চাত্যের সঙ্গীতকে নিবিষ্ট অনুশীলনে আত্তীকরণ করিয়াছেন, বারে বারে দুই স্রোতের প্রাণ মিলাইয়াছেন, তাঁহার মানসে কখনওই সঙ্গীত বা শিক্ষা বা প্রয়োগের কোনও শুচিবায়ুগ্রস্ত সীমারেখা ছিল না। পাশ্চাত্যের বহু নক্ষত্রপ্রতিম সঙ্গীতকার ও বাদ্যশিল্পী তাঁহার বাদন ও সঙ্গীতভঙ্গিতে আকৃষ্ট হইয়া তাঁহার সহিত যুগ্মসঙ্গীত নির্মাণ করিয়াছেন, তাঁহার নিকট সঙ্গীত শিক্ষা করিয়াছেন। আবার জাপানের শিল্পীর সহিত একযোগে কাজ করিয়া, প্রাচ্যের দুই ভিন্নধর্মী সঙ্গীত মিলাইয়া, জাপানি ও ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত ব্যবহার করিয়া রবিশঙ্কর নিরীক্ষা করিয়াছেন। নূতনকে, অভিনবকে, সম্ভাবনাময়কে, সে যে মাটি বায়ু জল হইতেই উদ্ভূত হউক এই অনবরত ও উদাত্ত সোৎসাহ আবাহন, নিজ দেশের মানচিত্রে বদ্ধ না থাকিয়া সমগ্র বিশ্বকে নিজ সৃষ্টিক্ষেত্র হিসাবে উপলব্ধি, নিজ কর্মকে তাহার বহুবিচিত্র রূপে উদযাপন: এক প্রকৃত বিশ্বনাগরিকের অভিজ্ঞান। রবিশঙ্কর তাঁহার অতিমানবিক প্রতিভার সহিত যোগ করিয়াছিলেন তাঁহার এই মুক্ত চিন্তা ও সকল উৎস হইতে প্রাণপণ রস শুষিয়া লওয়ার প্রতিজ্ঞা।
এই বিশ্বনাগরিকতা আকাশ হইতে সহসা দৈব অনুগ্রহে পতিত হয় না, ইহার জন্য প্রয়োজন: নিবিড় পরিকল্পনা ও নাছোড় প্রস্তুতি। রবিশঙ্কর প্রথম হইতেই এই বৃহৎ জীবনের চিত্র প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। যখন পাশ্চাত্যের এক নব্য যুবার ন্যায় জীবন কাটাইতেছেন ও অগ্রজের নৃত্যদলের সহিত বিশ্ব ঘুরিতেছেন, তখন আলাউদ্দিন খাঁ-র ‘তিরস্কার’ শুনিয়াই তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া স্বপ্রতিভার প্রকৃত বিকাশের জন্য মশা-ছারপোকা-সাপ অধ্যুষিত গ্রামে চলিয়া আসা সহজ সিদ্ধান্ত নহে, সেই সিদ্ধান্তে সাত বৎসর ধরিয়া অটল থাকা, কঠিনতর। কিন্তু তিনি জানিতেন, নিজ ভিত্তিশিকড় সুদৃঢ় অটল না হইলে, পরবর্তী উড়ালের ডানাগুলি নড়বড়ে হইয়া যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। আবার ওই শিকড়ের ঘেরাটোপে চির-আবদ্ধ হইয়া গেলেও চলিবে না, সেই মায়া, আলস্য ও আত্মঘাতী স্বাভিমান সজোরে কাটাইতে হইবে। তাহার প্রতিও তিনি সযত্ন দৃষ্টিবান ছিলেন, ১৯৫৬ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর সঙ্গীত নির্দেশকের পদ ত্যাগ করিয়া ইউরোপ ও আমেরিকায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া সেতারবাদনের সুযোগ গ্রহণ করিতে দ্বিতীয় বার ভাবেন নাই। নিজেকে তৈয়ারি করিয়াছিলেন যে আত্মসংযমে, নিষ্ঠায়, নিজেকে বিস্তৃত করিয়াছিলেন সম মাত্রার নির্ভীকতায়, প্রাণপ্রাচুর্যে। দেবদত্ত প্রতিভা লইয়া অনেকেই জন্মান, কিন্তু সকলে তাহার সহিত শ্রমিকের অধ্যবসায় যোগ করিতে পারেন না, কেহ এই দুই শস্ত্রই তূণে রাখেন কিন্তু ইহার সহিত অর্জন করিতে পারেন না এক পরিব্যাপ্ত দৃষ্টিপরিধি। রবিশঙ্কর এই তিনটি অসামান্য গুণই নিজ চিত্তবৃত্তি দিয়া অনবরত সিঞ্চিত করিয়াছিলেন ও নিজ কীর্তি কোন সুবিশাল প্রসারিত ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করিতে চান, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা লালন করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। যে অবিশ্বাস্য আত্মপ্রয়োগ দ্বারা সেই অভীপ্সা বাস্তবায়িত করা সম্ভব, তাহাও তিনি সাধন করেন ও রবিশঙ্কর হন। মহান ব্যক্তির সংখ্যা বাঙালির ভাণ্ডারে অনেক কালই বিরল, রবিশঙ্করের প্রয়াণে তাহা আরও দরিদ্র হইয়া পড়িল। আজ তাঁহার স্মৃতিতর্পণে এই সঙ্কীর্ণতাপূজক জাতি যদি বিস্তারের দীক্ষায় জাগিয়া উঠে, তবে এই বৃহৎ বাঙালির অবদান নূতন মাত্রা পায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.