তার ছিঁড়ে গেছে।
১৪০বি রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে তার বাঁধার ঘরেও সেই হাহাকার।
ঠিকানাটা হেমেন অ্যান্ড কোম্পানির। পোশাকি নাম ওটা, কিন্তু ভারতীয় সঙ্গীতের তারযন্ত্রের ইতিহাস জানে, ওটা ‘হেমেনবাবুর দোকান’। ত্রিকোণ পার্কের উল্টো দিকে হেমেনবাবু, হেমেন্দ্রচন্দ্র সেনের সেই ছোট্ট দোকানটার সামনে বুধবার বিকেলে গিয়ে দেখা গেল সাজিয়ে রাখা আছে রবিশঙ্করের পছন্দের আঙুরপাতা-ছাপ সেতার। ভিতরে বাবা আলাউদ্দিন, আলি আকবর খান, বিলায়েত খানের সঙ্গে যুবক রবিশঙ্করের বাদনরত ছবি।
হেমেনবাবু মারা গিয়েছেন বছর দুয়েক আগে। এখন দোকান চালান তাঁর দুই ছেলে রতন ও তপন। “পিসেমশাই কলকাতায় এলে বাবার কাছে আসতেনই। ওঁর সেতার বাবাই তৈরি করতেন তো,” বলছিলেন রতনবাবু। “আমরা পিসেমশাই-ই বলতাম, বাবা বলতেন রবুদাদা,” যোগ করলেন তপনবাবু। |
ওঁদের কাছেই জানা গেল, প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে রবিশঙ্করের সঙ্গে পরিচয় হেমেন্দ্রচন্দ্রের। সূত্রটা বাবা আলাউদ্দিনের কাছে সঙ্গীতশিক্ষা। তার পর থেকে ভুবনকাঁপানো সেই হাতে অধিকাংশ সময়েই উঠত হেমেনবাবুর সেই সেতার। খারাপ হলে সারিয়েও দিতেন তিনিই। কেমন যন্ত্র পছন্দ করতেন রবিশঙ্কর? দুই ভাই জানালেন, আঙুরপাতা-ছাপ, ফুল ডেকরেটিভ সেতার। সাতটা মূল তার, খরজ-পঞ্চম এবং খরজের ‘সা’ থাকতেই হত। তরফ থাকত ১৩টা। ওপরে থাকত ছোট ‘তুম্বা’। আর বিলায়েত খানের মতো কালো সেতার নয়, রবিশঙ্কর নিতেন ন্যাচারাল পালিশের সেতার।
বাজনায় যেমন, যন্ত্রের পছন্দেও তেমন আলাদা ছিলেন রবিশঙ্কর-বিলায়েত, সেতারের দুই মহারথী। বিলায়েত তেমন ডেকরেশন চাইতেন না, ছোট তুম্বাহীন ন্যাড়ামাথা সেতারই তাঁর পছন্দ ছিল। তাঁর সেতারের মূল তার ছ’টা, তরফ ১২টা। আর, বিলায়েত চাইতেন গান্ধার-পঞ্চম, জানাচ্ছেন হেমেনবাবুর ছেলেরা। আর এ ভাবেই, কারিগরদের দুনিয়ায় সেতারের ধরনে দুটো ভাগই হয়ে গিয়েছে, রবিশঙ্করের স্টাইল আর বিলায়েতের স্টাইল।
হেমেন্দ্রচন্দ্রই মুখ্য, তবে এ শহরের আরও কিছু কারিগর ও দোকান থেকে যন্ত্র কিনতেন রবিশঙ্কর। বৌবাজারের নদেরচাঁদ মল্লিক ওরফে নদু মল্লিক, কানাইলাল অ্যান্ড সন্স, হীরেন রায় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ঘনিষ্ঠতায় হেমেনবাবুর নামই সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে ‘পণ্ডিতজি’র সঙ্গে। তাই শূন্যতাও হয়তো সবচেয়ে বেশি। বিষণ্ণ বিকেলের সুরহারা হাওয়ায় সেই শূন্যতাই ঘিরে ছিল আঙুরপাতা-ছাপ সেতারটাকে। |